মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার সন্ধ্যায় ঘোষণা করেছেন, ইসরায়েল ও ইরান একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তিনি বলেছেন, এটি একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ইরানে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর ইরান প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। এরপর দুই দেশের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় বোমা হামলা করে। প্রায় ১২ দিন ধরে চলা সংঘাতের পর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে দুই দেশ।
ইরান বলেছে, ইসরায়েল যদি হামলা বন্ধ করে, তবে তারাও হামলা বন্ধে প্রস্তুত। অন্যদিকে ইসরায়েল বলেছে, ইরানে তাদের হামলার ‘উদ্দেশ্য অর্জন’ হয়েছে, তাই তারা এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে।
তবে, যুদ্ধবিরতি আদৌ টেকসই হবে কি না- তা নিয়ে এরই মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েল এবং ইরান উভয়ই এটি লঙ্ঘন করেছে। অবশ্য তিনি এ-ও বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরান উভয়েই সমানভাবে যুদ্ধ বন্ধ চেয়েছিল।
যদি যুদ্ধবিরতি বহাল থাকে, তাহলে আশা করা হচ্ছে যে, এটি একটি স্থায়ী শান্তিতে রূপ লাভ করবে। কিন্তু এর জন্য প্রচুর দক্ষ কূটনীতির প্রয়োজন হবে।
যুদ্ধবিরতি কী?
জাতিসংঘের মতে, ‘যুদ্ধবিরতি’ শব্দটির কোন একক, সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। যদিও শব্দটি সামরিক আদেশ ‘সিজ ফায়ার’ (যুদ্ধবিরতি) শব্দটি থেকে এসেছে, যা ‘ওপেন ফায়ার’ (গুলি করো) আদেশের বিপরীত।
এর মানে হলো যুদ্ধরত দুই পক্ষ তাদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে যেসব শর্ত সাপেক্ষে যুদ্ধ বন্ধ করতে সম্মত হয়, সেটিই ‘যুদ্ধবিরতি’। একে ‘শান্তিচুক্তি’ এবং ‘অস্ত্রসংবরণ’ও বলা যেতে পারে।
জাতিসংঘ বলেছে, ‘যুদ্ধবিরতি’ এবং ‘সংঘর্ষ বন্ধ করা’র মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। সংস্থাটির মতে, ‘সংঘর্ষ বন্ধ করা’ সাধারণত যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য একটি অনানুষ্ঠানিক চুক্তি।
সাধারণত ‘যুদ্ধবিরতি’ অনেকটা আনুষ্ঠানিক হয় এবং এতে কিছু শর্ত থাকে, যেগুলোর আওতায় দুই পক্ষ চুক্তিবদ্ধ হয় এবং কেউ চুক্তি ভঙ্গ করলে ফের যুদ্ধ শুরুর ঝুঁকি থাকে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ থাকে, যেমন-
• যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্য
• কখন থেকে এটি কার্যকর হবে
• এর পরে কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করা হবে
• এটি কোন ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে
চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলো কোন কোন সামরিক কার্যকলাপ চালাতে পারবে, আর কোনটি পারবে না এবং যুদ্ধবিরতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে, তাও স্পষ্ট উল্লেখ থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৩ সালে লাইবেরিয়ার একটি গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে যখন অন্তর্বর্তী জাতীয় ঐক্যের সরকার ন্যাশনাল প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট অব লাইবেরিয়া এবং ইউনাইটেড লিবারেশন মুভমেন্ট অব লাইবেরিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করে।
এতে উভয় পক্ষই অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমদানি বন্ধ করা, সামরিক অবস্থান পরিবর্তন না করা, বা অপর পক্ষকে আক্রমণ না করা, আরও শত্রুতা উসকে না দেওয়া এবং মাইন ও অগ্নিসংযোগকারী কোনো ডিভাইস ব্যবহার না করতে সম্মত হয়।
যুদ্ধবিরতি স্থায়ী নাকি অস্থায়ী?
জাতিসংঘ বলছে, এটি উভয়ই হতে পারে।
কখনো কখনো যুদ্ধে লিপ্ত দুটি বিরোধী পক্ষ একটি অস্থায়ী বা প্রাথমিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এটি সহিংসতা কমাতে বা মানবিক সংকট কমানোর লক্ষ্যেও হতে পারে।
যখন ইসরায়েল এবং হামাস-নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, তখন হামাস প্রায় ২৪০ জন বন্দির বিনিময়ে ১০৫ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয়।
একটি প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি অনেক সময় এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারে, যাতে তা শান্তি আলোচনায় সহায়তা করে এবং একটি স্থায়ী বা একটি নির্দিষ্ট যুদ্ধবিরতির পথ তৈরি করতে সাহায্য করে।
যেমন- ২০০০ সালের জুনে, ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়া সংঘাত থামাতে একটি অস্থায়ী শান্তি চুক্তি করা হয় যাতে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করা যায়। পরে ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে আলজিয়ার্স চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ওই সংঘাতের পুরোপুরি অবসান ঘটায়।
তবে, অনেক সময় প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি ভেস্তে গেলে যুদ্ধ তীব্র আকারও ধারণ করতে পারে।
যেমন, জাতিসংঘ লেবাননে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য ১৯৭৮, ১৯৮১ এবং ১৯৮২ সালে একাধিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে। তবে, প্রতিটি যুদ্ধবিরতির পর ফের গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধটি ১৯৯০ সালে এসে শেষ হয়।
কিছু ক্ষেত্রে, যুদ্ধরত পক্ষের একজন বা উভয় পক্ষই যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে সময়ক্ষেপণের জন্য প্রাথমিক যুদ্ধবিরতিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
তবে দুটি বিবদমান পক্ষের মধ্যে সফল শান্তি আলোচনার পরেই সাধারণত একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি স্থাপন করার সুযোগ হয়।
এতে সাধারণত যুদ্ধরত বাহিনীগুলোকে নিরস্ত্রীকরণ, তাদের সামরিক সক্ষমতা কমানো বা কোনো বাহিনীকে পুরোপুরি বিলুপ্ত ও নিরস্ত্র করার মতো প্রক্রিয়া জড়িত থাকে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরে বহু বছর ধরে এসব প্রক্রিয়াগুলোও চলতে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৮ সালে, উত্তর আয়ারল্যান্ডের ‘গুড ফ্রাইডে’ চুক্তিতে ‘প্রবিশনাল আইআরএ’ এবং ‘লয়ালিস্ট গ্রুপ’ তাদের অস্ত্র ‘ব্যবহারের বাইরে’ রাখতে সম্মত হয়েছিল।
চুক্তিতে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে শান্তি ও সম্প্রীতি উন্নয়নের জন্য কিছু ধারা অন্তর্ভুক্ত কর হয়েছিল, যেমন- উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের মধ্যে সীমান্ত সংঘাতমুক্ত রাখা এবং শুল্কমুক্ত বাণিজ্যে চালিয়ে যাওয়া।
সীমিত যুদ্ধবিরতি মানে কী?
ইসরায়েল এবং হামাস ২০২৩ সালের নভেম্বরে তাদের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিকে ‘মানবিক বিরতি’ বলে অভিহিত করেছিল।
মানবিক বিরতি কখনো কখনো যুদ্ধের সহিংসতা কমাতে বা মানবিক সংকট কমানোর জন্য করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, সুদান সরকার দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী, ‘সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট’ এবং ‘জাস্টিস এন্ড ইক্যুইলিটি মুভমেন্ট’-এর সাথে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। এটি দারফুরে লড়াই বন্ধ করে স্থানীয় জনগণের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংস্থাগুলোকে ৪৫ দিনের সময় দেয়।
২০০৪ সালে, ইন্দোনেশিয়ায় সুনামির আঘাত হানার পর, ইন্দোনেশিয়ার সরকার এবং ‘ফ্রি আচেহ মুভমেন্ট’ উভয়ই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। যাতে তারা যে এলাকায় লড়াই করছে, সেখানে জরুরি সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যায়।
অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট এলাকায় যুদ্ধ বন্ধ করার জন্যও চুক্তি হতে পারে, যাকে ভৌগোলিক যুদ্ধবিরতি বলা হয়।
২০১৮ সালে, জাতিসংঘ স্থানীয় জনগণকে রক্ষা করার জন্য লোহিত সাগরে ‘হোদেইদা’ বন্দরের আশপাশে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ইয়েমেন সরকার এবং হুথিদের মধ্যে একটি চুক্তি করে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/