মশা, ছোট্ট একটি পতঙ্গ হলেও এর কামড়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। প্রতি বছর মশাবাহিত রোগে প্রায় ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষ মারা যায় এবং ৭০ কোটিরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ বেশি ভোগেন মশাবাহিত নানান রোগে। দেশে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় প্রতিদিন।
মশারি, কয়েলসহ মশার কামড় থেকে বাঁচতে কত কিছুই না করছেন। তাতেও রেহাই মিলছে না। কিন্তু জানেন কি, এমন এক দেশ আছে যেখানে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুঁজলেও একটি মশা খুঁজে পাবেন না। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এটি সত্যি।
পৃথিবীতে যেখানে মানুষকে মশার উৎপাত থেকে বাঁচতে নানা রকম কৌশল অবলম্বন করতে হয়-কখনো মশারি, কখনো কয়েল, কখনো আবার স্প্রে ব্যবহার- সেখানে একটি দেশ আছে যেটি মশার ঝামেলা একেবারেই মুক্ত। দেশটির নাম আইসল্যান্ড। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশেই কোনো না কোনোভাবে মশা পাওয়া গেলেও আইসল্যান্ডে একটিও মশা নেই। এই কারণে দেশটি শুধু তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, বরং অনন্য জীববৈচিত্র্যের জন্যও বিশ্ববাসীর কাছে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
এই দেশে শুধু মশাই নয়, কোনো পোকামাকড় এমনকি সাপও নেই। দেশটির প্রতিবেশী দেশ নরওয়ে, ডেনমার্ক, স্কটল্যান্ড এমনকি গ্রীনল্যান্ডেও যথেষ্ট মশার উৎপাত আছে। নেই শুধু আইসল্যান্ডে। আইসল্যান্ডের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না মশারা।
আইসল্যান্ডে আবহাওয়া সবসময় পরিবর্তনশীল। কখনো তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়, আবার হঠাৎ নেমে যায় শূন্য ডিগ্রির নিচে। মশার জীবনচক্রের জন্য স্থায়ী তাপমাত্রা ও পানির প্রয়োজন। কিন্তু এই হঠাৎ পরিবর্তন মশার ডিম বা লার্ভা টিকে থাকতে দেয় না।
মশার বংশবিস্তার হয় সাধারণত স্থির পানিতে। কিন্তু আইসল্যান্ডে শীতকালে পানি দ্রুত জমে বরফে পরিণত হয় এবং গ্রীষ্মকালে আবার গলে যায়। এই অস্বাভাবিক ওঠানামার ফলে মশার বংশবৃদ্ধি সম্ভব হয় না। এখানকার হ্রদে মশারা বংশ বিস্তারের আসলে সুযোগই পায় না। কারণ বছরে তিনবার হ্রদগুলো পুরোপুরি বরফে পরিণত হয়।
এর বৈশ্বিক অবস্থানও এর জন্য কিছুটা দায়ী। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে দ্বীপ দেশ হওয়ায় বাইরের পরিবেশ থেকে মশা আসার সুযোগও কম। অন্য জায়গা থেকে মশা প্রবেশ করলেও টিকে থাকতে পারে না।
আরও মজার বিষয় হলো আইসল্যান্ডিক ইনস্টিটিউট অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে মশার দেহাবশেষ সংরক্ষিত আছে। দ্য টেলিগ্রাফের মতে, অ্যান্টার্কটিকা এবং আইসল্যান্ড পৃথিবীর এমন দুটি অবস্থান যেখানে বিরক্তিকর কীটপতঙ্গ কখনো আবাস গড়তে পারেনি।
মশা না থাকার কারণে আইসল্যান্ডবাসী অনেক সুবিধা ভোগ করে। যেমন-রোগমুক্ত পরিবেশ: পৃথিবীর বহু দেশে মশা-জনিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। আইসল্যান্ডে এসব রোগ নেই বললেই চলে।
নিরিবিলি জীবনযাপন করতে পারেন তারা। মশার শব্দ বা কামড়ের ঝামেলা ছাড়াই মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে দেশটি। যারা গরম দেশে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ, তারা এখানে এসে স্বস্তি পান। অনেক ভ্রমণকারী বিশেষভাবে এই কারণেও আইসল্যান্ডকে আলাদা করে উল্লেখ করেন।
আইসল্যান্ডে মশা না থাকা শুধু একটি অদ্ভুত প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং বিজ্ঞানীদের জন্যও গবেষণার বিষয়। অনেকেই মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভবিষ্যতে হয়তো মশা সেখানে ঢুকে পড়তে পারে। তবে এখন পর্যন্ত দেশটি পৃথিবীর একমাত্র স্বাভাবিকভাবে মশামুক্ত দেশ হিসেবেই পরিচিত।
আইসল্যান্ড উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র। আইসল্যান্ডকে বলা হয় ‘আগুন ও বরফের দেশ’। কারণ এখানে যেমন আছে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ও লাভার প্রবাহ, তেমনি আছে বিশাল হিমবাহ ও বরফঢাকা পাহাড়।
আইসল্যান্ডে প্রকৃতির সৌন্দর্য এক কথায় অপূর্ব। বরফাচ্ছাদিত পর্বত, লাভার তৈরি কালো বালির সমুদ্রতট, উত্তরের আলো বা অরোরা বোরেলিসের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, অসংখ্য জলপ্রপাত, উষ্ণ প্রস্রবণ-সব মিলিয়ে এক অন্যরকম জগতের অনুভূতি দেয় এই দেশ। এখানকার মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করে।
তবে মশা না থাকলেও আইসল্যান্ডবাসীর জীবন একেবারে সহজ নয়। কঠিন শীত, দীর্ঘ অন্ধকারময় শীতকাল, খাদ্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধতা-এসবের সঙ্গে তাদের খাপ খাইয়ে নিতে হয়। তবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই এখানকার শান্ত, সুন্দর প্রকৃতি জীবনযাপনকে করে আরও শান্তিময়।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, সিএনএন
কেএসকে/এএসএম