যেখানে আবেগ ও বিবেক জড়িত

2 weeks ago 10

দারুস সালাম মাসুদ

আমরা জানি, আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর ও কার্যকর আবিষ্কার হলো রোবট। মানুষের আদলে তৈরি রোবটগুলো মানুষের মতোই সুন্দর ও কর্মক্ষম। শুধু তা-ই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের চেয়েও অধিক বলবৎ ও ফলপ্রসূ। তাই বলে মানুষের চেয়ে রোবট বড় নয়। মানুষ আশ্রাফুল মাখলুকাত—সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষ আর রোবটের মধ্যে পার্থক্য হলো—অদৃশ্য প্রাণের, যেখানে আবেগ ও বিবেক জড়িত। যা প্রকৃত অর্থে রোবটের নেই, মানুষের আছে।

আবেগ হলো—হৃদয়ের চেতনা, অনুভূতি, উপলব্ধি; যা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। যার ফলে আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও পারিপার্শ্বিক আচার-আচরণে ছাপ ফেলে। যদিও একে ধরা-ছোঁয়া যায় না, তবু মানুষের জীবনে এটি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অভিজ্ঞতা, আচরণ, সম্পর্ক এবং যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণেও এটি প্রভাবিত করে। আবেগকে অনুভূতি কিংবা উপলব্ধির সমার্থক মনে করা হলেও অনুভূতি বিষয়টা শারীরিক ও মানসিক উভয়ের ক্ষেত্রে হতে পারে। কিন্তু আবেগ মূলত মানসিক একটা ব্যাপার। যার ফলশ্রুতিতে এর প্রভাবে আমাদের মনের এবং শরীরের পরিবর্তন প্রকাশ পায়। আরেকটু খুলে বললে, আবেগ মানে ব্যকুলতা, উত্তেজনা, ভাবাবেশ, চিত্ত চাঞ্চল্য—যেটা হৃদয়ের তীব্র অনুভূতিতে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সেই অর্থে রাগ, ক্ষোভ, প্রেম-ভালোবাসা, বিশ্বাস, সুখ-আনন্দ, দুঃখ, ঘৃণা, উদ্বেগ, ভয় ইত্যাদি আবেগের মধ্যে পড়ে।

বিবেক হলো—বিচার বিশ্লেষণ করার যৌক্তিক ক্ষমতা। যেটা ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বোঝাতে সহায়তা করে। বিবেক আছে বলেই মানুষ ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ হয় এবং মন্দ কাজকে ঘৃণা করে, ন্যায়-অন্যায় বাছাই করতে পারে। বিবেক আছে বলেই মানুষের বিপদে মানুষ সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বিবেক মানে ন্যায়-অন্যায় বিচারে মানুষের অন্তর্নিহিত একটি প্রচ্ছন্ন শক্তি, উচিত-অনুচিতের পার্থক্য নির্ণয়ে মানুষের অন্তর্বাসী ক্ষমতা বা বিচারবোধ। এটা একটা মানুষের জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া, যা কোনো মানুষের নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ পায়।

শিরোনামের যৌক্তিক প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরতে এখানে প্রথমে রোবটের সাথে তুলনা করেছি। সত্যিকারার্থে একটা রোবটজীবনের কোনো প্রকৃত আবেগ ও বিবেক থাকে না। কিছু অনুভূতি ক্ষমতা হয়তো বিজ্ঞানীরা তাদের যোগ করে দিতে পারেন কিন্তু সেটা মানুষের ন্যায় হৃদয়ের আবেগ সমতুল্য কখনোই হতে পারে না। রোবট মনুষ্যসৃষ্ট একটা যন্ত্র মাত্র। কোনো যন্ত্রেরই মানুষের মতো আবেগ ও বিবেক থাকে না। শ্রেষ্ঠকূল মানুষ ছাড়াও এ জগতে অসংখ্য প্রাণীর বসবাস। অনেক প্রাণীর মধ্যেও কিছু কিছু আবেগ ও বিবেক পরিলক্ষিত হয়। তাদেরও সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, ভয়-ক্রোধ দেখা যায়। তবে তাদের আবেগ ও বিবেক মানুষের মতো এতটা মার্জিত ও নিকষিত হতে পারে না। মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব বলেই তাদের আবেগ-বিবেক উচুঁমান ক্ষমতাসম্পন্ন ও মহার্ঘ।

মানবজীবনের সৌন্দর্য হয়তো অনেক কিছুর মধ্যে লুকায়িত থাকতে পারে। তবে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, এর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য দুটো জিনিসে, ১. আবেগ, ২. বিবেক। এ দুটো জিনিস যে মানুষের ভেতর নেই—প্রকৃত অর্থে তাকে কি মানুষ বলা যায়? সেটাকে কি মানবজীবন বলা যায়? আমার তো মনে হয় এ দুটো জিনিস যার হৃদয়ে নেই; সে মানুষরূপী রোবটের মতো। সে হয়তো দু’হাত দিয়ে কাজ করে যেতে পারে, হাঁটতে চলতে পারে বটে কিন্তু তার কোনো ন্যায়-অন্যায়, বিচার-অবিচারের পার্থক্য নির্ণয়ে অন্তর্নিহিত জ্ঞানীয়বোধ থাকে না। এমনকি যথাযথভাবে সুখ-দুঃখের উপলব্ধিও থাকে না। হৃদয়বিদারক কোনো কিছুতেও সে দুঃখ পায় না। চোখের সামনে ভয়ানক অপরাধ দেখেও তার কোনো সুবোধ জাগ্রত হয় না। দুঃস্থ অসহায়দের দেখেও কখনো সাহায্য-সহযোগিতা করতে আগ্রহ হয় না। এসব মানুষের বিবেকের কোনো তাড়না থাকে না বলে অন্যায় দেখেও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে চায় না।

বর্তমান সমাজে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো—নিজেকে নিজে একজন মানুষ দাবি করা। নিজেকে মানুষ দাবি করার জন্য একজন মানুষের যা যা থাকা দরকার, তার কতটুকু এখন আমাদের ভেতর আছে? আমি নিজেও নিজেকে নিয়ে মাঝেমাঝে চিন্তিত ও শঙ্কিত হই। অনেকের ভেতরই এখন আর বিবেক নেই, আবেগ নেই। আবেগ ও বিবেক উভয়ই মরে যাচ্ছে। যার ফলে অনেকে এখন রুক্ষ ও পাষাণ এমনকি ভয়ংকরও। কেউ কেউ হরদম অপরাধ করেই যাচ্ছেন। আবার অপরাধ করে গর্ববোধও করছেন বুক ফুলিয়ে। মানুষের ভেতর যদি ন্যূনতম ইতিবাচক আবেগ ও বিবেক থাকতো, তাহলে সামন্য ঘটনায় মানুষ মানুষকে খুন করতে পারতো না। যা আজকালকার পরিবার ও সমাজে প্রায়ই পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিত্যদিনের কিছু ঘটনা এবং পত্রিকা পড়লেই বোঝা যায়, আসলে মানুষের বিবেক এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!

মূলত একজন মানুষের বিবেক জন্ম হয় তার আবেগ থেকে। মনুষ্যজীবনের যে কোনো কিছুতে সর্বপ্রথম নাড়া দেয় আমাদের আন্তর্নিহিত আবেগ। আবেগের ওপর নির্ভর করে আমরা প্রথমে উপলব্ধি করি এবং সেখান থেকেই বিবেকের উৎপত্তি। এজন্য আবেগ ছাড়া কোনো মানুষের বিবেক তৈরি হতে পারে না। যার ভেতর আবেগ আছে; তার ভেতরেই বিবেক কাজ করে। এখানে একটা আরেকটার সাথে অদৃশ্যভাবে যুক্ত।

মনুষ্যজীবনে আবেগ থাকাটাই সুন্দর ও শোভনীয়। যার কোনো আবেগ নেই; সে হয়তো এক ধরনের প্রতিবন্ধী কিংবা রোবট সমতুল্য। আমরা আমাদের জীবনে সুখে আনন্দ পাই, দুঃখে কষ্ট পাই মূলত আবেগের কারণেই। সেই অর্থে আবেগ থাকাটা আবশ্যক ও ফলদায়ক। আমাদের সুখবোধের পাশাপাশি দুঃখবোধ থাকাও জরুরি। দুঃখ করতেও জানতে হয়, না হলে নিজের কিংবা অন্যের দুঃখে আমরা অনায়াসে হেসে উঠবো। যা কি না উন্মাদের পর্যায়ে পর্যবসিত হতে পারে। আবার শুধু হেসে হেসে জীবনকে উড়িয়ে দিলেও কখনো আমাদের বিবেকবোধ জাগ্রত হতে পারে না। বিবেকবোধ জাগ্রত না হলে সমাজ থেকে কখনো চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন-খারাবি, বৈষম্য, দুর্নীতি শেষ হবে না।

আবেগহীন মানুষ কখনো মানবিক গুণসম্পন্ন হতে পারে না। এজন্য যথাযথ ও ইতিবাচক আবেগ বজায় রাখার জন্য জীবন-যাপনে নৈতিকতার চর্চা জরুরি। পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞান থাকাও প্রয়োজন। মানুষের বিপদে-আপদে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যাওয়া এবং অনাথ-অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো উচিত। অবৈধ পন্থায় রাতারাতি আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার বদচিন্তা বাদ দিয়ে সৎ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। বাস্তবসম্মত চিন্তা করতে হবে এবং মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখতে হবে।

মানুষের বিবেক মনুষ্যত্বের একটা বড় মানদণ্ড। এজন্য বিবেক থাকা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, আবশ্যকও। বিচারবোধ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দায়বদ্ধতা ও কর্তব্যবোধ থাকার জন্য প্রতিটা জীবনে বিবেক প্রয়োজন। বিবেক মানুষকে তার কর্তব্যপালনে উদ্বুদ্ধ করে এবং তার কাজের জন্য দায়ী করে। এটা মানুষের আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কেউ যদি অপরাধ করার পর তার বিবেক তাকে অনুতপ্ত ও দুঃখিত করে; তখন সে ভবিষ্যতে সঠিক কাজ করতে উৎসাহিত হয়। তাই বিবেকবোধ জাগ্রত রাখতেও নৈতিক জীবন-যাপন দরকার।

মানুষের আবেগ না থাকা যেমন অস্বাভাবিক; তেমনি অতিরিক্ত আবেগের পরিস্ফুটনও অস্বাভাবিক। আবেগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেলে শারীরিক ও মানসিক বিপদ হতে পারে। মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যেমন- অতিরিক্ত রাগের কারণে হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাস বৃদ্ধি পেতে পারে। অনেকে আছেন খুব সহজে রেগে যান, জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন, এমনকি হুঁশ থাকে না। এরূপ অনিয়ন্ত্রিত রাগের কারণে লিভারের ক্ষতি হতে পারে। দুঃখে দুঃখবোধ করাটা স্বাভাবিক হলেও সেটা যদি দুই-তিন সপ্তাহের বেশি হয়ে যায়, তবে তা বিষণ্নতায় রূপ নিতে পারে। ফলে অনিদ্রা, শারীরিক দুর্বলতা, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, কোষ্টকাঠিন্যসহ স্মৃতিশক্তির সমস্যা ও কাজে মনোনিবেশ করতে অক্ষমতা পরিলক্ষিত হতে পারে। অতিরিক্ত ভয় কিডনি ও পাকস্থলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী ভয়ে ভুগলে লিভার ও হার্টের সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা হতে পারে। অতিরিক্ত আবেগের কারণে মানসিক চাপ সৃষ্টি হলে দুশ্চিন্তা থেকেও মস্তিস্ক ও হার্ট দুর্বল হতে পারে। দীর্ঘদিন হতাশায় থাকলে ফুসফুসের ক্ষতিও হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আবেগতাড়িত হয়ে কাউকে বেশি মাত্রায় বিশ্বাস করলে এবং পরে সেই বিশ্বাস ভেঙে গেলে কষ্ট ভোগ করতে হয়—যা জীবনের জন্য ক্ষয় ও ক্ষতিকর।

অতিরিক্ত আবেগ থেকে বেঁচে থাকার জন্যও আমাদের সর্তক থাকতে হবে। নিজের ওপর বিশ্বাস, নিজেকে যথাযথভাবে চেনা, নিজেকে সময় দেওয়া, ‘না’ বলতে শেখা, নিজের জন্য ক্ষতিকর মানুষগুলোকে জীবন থেকে চলে যেতে দিতে হবে। তাছাড়া নিজের চিন্তা-ভাবনাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বিশ্বস্ত কারো সাথে কথা বলে সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

আবেগ-বিবেক ছাড়াও হয়তো মানুষ বাঁচতে পারে, চলতে পারে, কিন্তু তাদের দ্বারা কখনো মানবিক ও প্রশংসনীয় কাজ হতে পারে না। তাদের দ্বারা কখনো সুকৃতি আশা করা যায় না। বরং বিবেকহীন মানুষের দ্বারাই পৃথিবীতে যত অন্যায়-অপরাধ ও অনৈতিক কাজ ছড়িয়ে পড়ে, সমাজ ও রাষ্ট্র অস্থির হয়, ধ্বংস হয় বর্তমান ও আগামী।

একজন মানুষের ভেতরের শুদ্ধতা ও পবিত্রতা প্রকাশ করে তার আবেগ ও বিবেক। এ দুটো ছাড়া একজন ব্যাক্তি ভালো মানুষ হিসেবে অসম্পূর্ণ। তাই জীবনে যথাযথ আবেগ ও বিবেক থাকা প্রয়োজন। আসলে মানবিক জীবন ধারণ করতে পারাটাই মনুষ্যজীবনের গুরু সার্থকতা। এর নেপথ্যে রয়েছে পরিমিত আবেগ ও বিবেক। যা মনুষ্যজীবনের অন্তর্নিহিত মাধুর্য ও সৌন্দর্য।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক।

এসইউ/জিকেএস

Read Entire Article