যেভাবে বেড়ে ওঠেন ফরিদা পারভীন

1 day ago 1

ফরিদা পারভীনের রক্তে ছিল গান! দাদি গান করতেন, বাবার ছিল গানের প্রতি অনুরাগ। ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে কিশোরী ফরিদা শুরু করেছিলেন পেশাদার সঙ্গীতজীবন। সেই থেকে শুরু, গতকাল শেষ হলো তার ৫৫ বছরের সঙ্গীতজীবন। ফরিদা পারভীনের প্রয়াণের মধ্যদিয়ে লালনসঙ্গীতের সুধময় এক কণ্ঠের পরিসমাপ্তি হলো। তবে তার ধারণকৃত কণ্ঠ বাঙালির মনকে প্রশান্তি দেবে যুগের পর যুগ।

লালনের গান গেয়ে ফরিদা পারভীন নিজেকে গগনস্পর্শী উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সুধীজনেরা তাকে লালনসম্রাজ্ঞী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। যদিও সঙ্গীতজীবন তিনি শুরু করেছিলেন নজরু, আধুনিক গান দিয়ে। দেশের গানেও ছিল তার অনন্য কণ্ঠ। তার গাওয়া ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ গানটি আজও বাংলাভাষী মানুষকে স্মৃতিকাতর করে।

নাটোরের সিংড়ায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন ছোটবেলায় ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। প্রায় সারাক্ষণ দৌড়ঝাঁপ আর খেলাধুলায় মেতে থাকতেন। দাদা ও নানাবাড়ির মাঝখানে ছিল এক নদ। আত্রাইয়ের সেই শাখানদের নাম ছিল গুর। ওই নদ পার হয়ে তরুণ ফরিদা দাদার বাড়ি থেকে নানার বাড়ি যেতেন। নানার বাড়ির পাশে বিরাট এক বিল ছিল। শৈশবে খেলার সঙ্গী মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে সেই বিলে শাপলা তুলতে যেতেন।

ফরিদার শৈশবের সময়টা তার কেটেছে মাগুরায়। স্কুলজীবনের শুরুটাও সেখানে। সে সময় ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে তার সঙ্গীতে হাতেখড়ি। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা হয়েছে তার। পড়তে হয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুলে। পরে দীর্ঘদিন কুষ্টিয়া শহরে ছিলেন ফরিদা। কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে স্নাতক। ওই শহরেই দীর্ঘদিন তিনি চর্চা করেছেন লালনগীতির।

শৈশব থেকেই ফরিদা পারভীনের পছন্দ ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। কে সন্ধ্যা, সেও তার জানা ছিল না তখন। বড় হয়ে পরে জানতে পারেন সন্ধ্যার মুখোপাধ্যায়ের নাম। রেডিও ছেড়ে দিয়ে তার গান শুনতেন। ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীন রাজশাহী বেতারে নজরুলশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর লালনগীতির সঙ্গে তার আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়। তখন তিনি কুষ্টিয়ায়। সেখানে তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা পারভীন তার কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটি শিখে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন। মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদাবক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালনসঙ্গীত শেখেন তিনি। এরপর মগ্ন হন লালনসঙ্গীতে।

ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী প্রখ্যাত গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর। সেই সংসারে তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরি উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি। তার দ্বিতীয় স্বামী বাঁশিশিল্পী গাজী আবদুল হাকিম।

লালন সাঁইয়ের বাণী ও সুরকে বিপুল সংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে অবদান রেখেছেন ফরিদা পারভীন। বিশ্বদরবারে তিনি লালণের বাণী ও সুর প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে লালনের গান পরিবেশন করেছেন তিনি।

সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে ফরিদা পারভীন একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ সিনেমায় ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তিনি ২০০৮ সালে জাপানের সম্মানসূচক ফুকুওয়াকা পুরস্কার লাভ করেন।

এমএমএফ/আরএমডি/এমএস

Read Entire Article