যেভাবে রাজসাক্ষী হন সাবেক আইজিপি মামুন
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় বিচার শুরুর প্রথম ঘটনা এটি। প্রথম রায়ও এটি। গত ১০ জুলাই সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে মামলাটিতে ‘অ্যাপ্রুভার’ হওয়ার আবেদন করেন। সেদিন কাঠগড়ায় থাকা এ মামলার একমাত্র গ্রেফতার করা আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের কাছে অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে চান ট্রাইব্যুনাল। কাঠগড়ায় থাকা সাদা-কালো চেকশার্ট পরিহিত মামুন তার বক্তব্য জানান। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে কথা বলেন সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন। ইংরেজিতে তিনি দায় স্বীকার করার কথা জানান। আদেশের পরে এক সংবাদ সম্মেলনে ওইদিন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি তার দোষ স্বীকার করেছেন। তিনি অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হতে চেয়েছেন। তিনি জানান, ‘অ্যাপ্রুভার’ হওয়ার মাধ্যমে জুলাই-আগস্টের সব অপরাধ উদঘাটনে সহায়তা করবেন পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আরও পড়ুন: রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় তসবিহ জপেন সাবেক আইজিপি মামুনহাসিনার রায় ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা: অ
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় বিচার শুরুর প্রথম ঘটনা এটি। প্রথম রায়ও এটি।
গত ১০ জুলাই সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে মামলাটিতে ‘অ্যাপ্রুভার’ হওয়ার আবেদন করেন।
সেদিন কাঠগড়ায় থাকা এ মামলার একমাত্র গ্রেফতার করা আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের কাছে অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে চান ট্রাইব্যুনাল।
কাঠগড়ায় থাকা সাদা-কালো চেকশার্ট পরিহিত মামুন তার বক্তব্য জানান।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে কথা বলেন সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন। ইংরেজিতে তিনি দায় স্বীকার করার কথা জানান। আদেশের পরে এক সংবাদ সম্মেলনে ওইদিন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি তার দোষ স্বীকার করেছেন। তিনি অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হতে চেয়েছেন।
তিনি জানান, ‘অ্যাপ্রুভার’ হওয়ার মাধ্যমে জুলাই-আগস্টের সব অপরাধ উদঘাটনে সহায়তা করবেন পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন:
রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় তসবিহ জপেন সাবেক আইজিপি মামুন
হাসিনার রায় ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা: অ্যাটর্নি জেনারেল
এ রায় প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচারের প্রতিজ্ঞা: চিফ প্রসিকিউটর
এর আগে ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট থেকে তদন্ত শুরু করে এবং মিস কেইস ফাইল করেন ১৬ অক্টোবর, এরপর ২৯ অক্টোবর তদন্ত শেষ করা হয়। শেখ হাসিনা ‘মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করেছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এরপর ২০২৫ সালের ১২ মে এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ এনে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। তারপরে ১ জুন শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এরপরে ১ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। ওইদিন অভিযোগ আমলে নিয়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব না হলে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে ১৬ জুন নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। বিজ্ঞপ্তি জারির পরও হাজির না হলে ২৪ জুন তাদের দুজনের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৮ এর সাবেক বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর ও আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবী আমির হোসেনকে তাদের পক্ষে মামলা লড়তে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। চলতি বছরের জুলাইয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়।
ওইদিন শুনানির শুরুতে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের সময় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত। তিনি তার বক্তব্য উপস্থাপনের সময় একটা বড় অংশজুড়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বাবা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গে কথা বলেন। শেখ হাসিনার ‘কৃত অপরাধের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য’ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আজীবন ক্ষমতা ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা ছিল শেখ হাসিনার। তার পিতাও চেয়েছিল এমনটা।
পরে ১০ জুলাই তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তিন আসামির বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়, ষড়যন্ত্র, উসকানি, হত্যা, পরিকল্পনাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে অ্যাপ্রুভার হিসেবে নিজের অপরাধের দায় স্বীকার করেন সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এরপর গত ৩ আগস্ট থেকে সাক্ষী গ্রহণ শুরু হয়ে ৫৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ৮ অক্টোবর শেষ হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত ১২ অক্টোবর থেকে মামলায় যুক্তি-তর্ক শুরু হয়ে ২৩ অক্টোবর শেষ হয়। ওইদিন ২৩ অক্টোবর মামলায় রায় ঘোষণার জন্য তারিখ নির্ধারণে ১৩ নভেম্বর দিন ঠিক করেন এবং ওইদিন ১৭ নভেম্বর রায়ের দিন ঠিক করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে প্রতিটি প্রমাণিত হয়েছে বলে রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এগুলোর মধ্যে এক নম্বর অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন পাঁচটি অভিযোগ তিনটি কাউন্টে ভাগ করে সাজা প্রদান করা হয়েছে আসামিদের।
তাদের বিরুদ্ধে গঠন করা প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। ওই বক্তব্যে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতি-পুতি বলে উল্লেখ করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র ‘আওয়ামী সন্ত্রাসী’ ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। প্ররোচনা, উসকানি, অপরাধ সংগঠন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, ষড়যন্ত্রের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে এতে। এই অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কারণ তিনি অপরাধ সংগঠনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে ‘ইমপ্রিসনমেন্ট টিল ন্যাচারাল ডেথ’ অর্থাৎ আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। এসব অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
এরমধ্যে দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ দিয়েছেন।
চার নম্বর অভিযোগে, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা ছয়জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
পাঁচ নম্বর অভিযোগ আশুলিয়ায় জীবিত একজনকেসহ মোট ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা এবং আশুলিয়ায় জীবিত একজনসহ ছয়জনকে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে, এই মামলার একমাত্র গ্রেফতার আসামি ও ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে প্রথম অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু অপরাধের ব্যাপকতা এবং যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যেসব অপরাধ তিনি করেছেন সেগুলোর জন্য তিনি সর্বোচ্চ শাস্তির যোগ্য। কিন্তু যেহেতু তিনি এই মামলাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সাহায্য করেছেন সে বিষয় বিবেচনায় তিনি ন্যূনতম সাজা পাবেন।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে আরও বলেন, তিনি সব এট্রোসিটিজের জন্য দায়ী। কিন্তু ঘটনার বিবরণ পূর্ণাঙ্গভাবে ডিসক্লোজ করেছেন তিনি। এসব বিষয় বিবেচনায় সাবেক এই আইজিপিকে ট্রাইব্যুনাল পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম
What's Your Reaction?