গতকাল রাত থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিলো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। রোববার দুপুর গড়ানোর আগেই সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ আন্দোলনকে ঘিরে চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনের হামলা ও সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত আড়াই শতাধিক মানুষ।
আহতদের মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী। নগরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২২০ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ। চারজন রয়েছেন আইসিইউতে।
রোববার (৪ আগস্ট) রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ও নগরীর বেসরকারি তিনটি হাসপাতাল থেকে এসব তথ্য জাগো নিউজকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত আমরা ১৩৫ জনকে চিকিৎসা দিয়েছি। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত ও ভারি বস্তুর আঘাতপ্রাপ্তরা রয়েছেন।’
‘এর মধ্যে তিনজকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
তবে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে জানা যায়, রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত এই হাসপাতালে আহত হয়ে শিশুসহ ১৭৩ জন ভর্তি হয়েছেন। এর বাইরেও জরুরিভাবে অনেককে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ।
জরুরি বিভাগের দায়িত্বে থাকা ডা. তুহিন দাশ শুভ্র বলেন, ‘আহত ১৭২ জনের মধ্যে ১১০ জন গুলিবিদ্ধ রয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা খারাপ। তারা বর্তমানের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।’
সরেজমিনে দেখা যায়, আহতদের বেশিরভাগই গুলিবিদ্ধ। এর মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এছাড়া অনেকের মাথা ও শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। আহতদের শরীরে বেধড়ক পেটানোর চিহ্নও রয়েছে। আহতদের মধ্যে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে পথচারীও রয়েছে।
রেড ক্রিসেন্টের যুব সদস্য তাহমিদ উদ্দিন বলেন, আমরা এমন ভয়ঙ্কর হতাহতের ঘটনা আগে কখনো দেখিনি। আহতদের অনেকে গুলিবিদ্ধ। হতাহতদের উদ্ধার করে চট্টগ্রামে তাদের ৩০ জনের টিম কাজ করেছি।
এদিকে নগরীর বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ডা. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে মোট ১৫ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৯ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যায়। বর্তমানের পাঁচজন ভর্তি রয়েছেন। একজন গুলিবিদ্ধ। আরও একজনের পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে আইসিইউতে পাঠানো হচ্ছে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, বেলা ১১টার পর থেকে অ্যাম্বুলেন্স ও সিএনজি অটোরিকশা করে একের পর এক আহতদের নিয়ে আসা হয় পার্কভিউ হাসপাতালে। এদের মধ্যে ছাত্রী ছিলো দুইজন। আহতদের সবাই ছিলো রক্তাক্ত।
নগরের মেহেবাগের বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে ১২ জন ভর্তি হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের পরিচালক আনোয়ার শরীফ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ১২ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। কয়েকজন গুলিবিদ্ধ। তবে আশঙ্কাজনক কেউ নেই।’
অন্যদিকে জিইসি মোড় এলাকায় অবস্থিত বেসরকারি হাসপাতাল মেডিকেল সেন্টারে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজসহ তিনজন ভর্তি হয়েছেন। দুইজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেলেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন গুরুতর আহত আজিজ।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই হাসপাতালের পরিচালক ডা. রাজত বডুয়া। তিনি বলেন, দুইজন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছে। তবে এখানে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজ চিকিৎসাধীন। তার মাথায় ও শরীরে আঘাত পেয়েছেন।
দিনভর হামলা-সংঘর্ষ
আজ রোববার সকাল ১০টা থেকে শিক্ষার্থীসহ আন্দোলনকারীরা নিউ মার্কেট মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিলো। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিটি কলেজ এলাকা থেকে বিক্ষোভরত আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় ছাত্রলীগ।
জাগো নিউজের হাতে আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সিটি কলেজ রোডের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অফিসের পেছন থেকে রিভলবার হাতে গুলি ছুড়ছে হেলমেট পরা এক লোক। তার পাশে থাকা আরেকজনকে ককটেল নিক্ষেপ করতে দেখা যায়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রিভলবার হাতে ওই ব্যক্তি হলেন সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতা মো. ফয়সাল।
এ সময় আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর আন্দোলনকারীরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে কদমতলী, কোতয়ালি ও রেয়াজউদ্দিন বাজারের আশপাশে অবস্থান নিলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে।
অন্যদিকে পুলিশের হামলা থেকে বাঁচতে তিনটি সড়কে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময়ই অধিকাংশ আন্দোলনকারী আহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শী শিফতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কদমতলী এলাকায় আন্দোলনকারীদের অনেককে ছুরিকাঘাত করা হয় প্রকাশ্যে। হামলাকারীদের অনেকের হাতে ছিলো রামদা ও চাইনিজ কুড়াল। এ সময় ছাত্রীদেরও মারধর করা হয়। তাদের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে নালায় ফেলে দেওয়া হয়।’
দুপুর ১২টার দিকে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ এনায়েত বাজার হয়ে কাজীর দেউড়িতে পৌঁছায়। এ সময় স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর দ্বিতীয় দফা হামলা চালায়।
দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১২টা ৪৫ পর্যন্ত এসএস খালেদ রোডে কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনতে পান বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা আবছার উদ্দিন।
ঘটনার সময় স্থানীয় জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের নেতৃত্বে শটগান ও পিস্তল হাতে দুই অস্ত্রধারীকে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় অংশ নিতে দেখা যায়।
হামলার মুখে আন্দোলনকারীরা বেলা ১টার পর শিক্ষার্থীদের একটি অংশ নগরের ওয়াসা মোড়ে অবস্থান নেয়। এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দুইদিক থেকে শিক্ষার্থীদের ঘিরে ফেলে। তখন পাশের ইঞ্জিনিয়ার কোরের সেনা সদস্যরা এগিয়ে শিক্ষার্থীদের রক্ষায় এগিয়ে আসে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় সেনা সদস্যরা রাস্তায় অবস্থান নেয় এবং হামলাকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরাও সেনাবাহীনিকে স্বাগত জানিয়ে স্লোগান দেন।
একই সময় লালদিঘী এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। অন্যদিকে কদমতলীতে হামলার শিকার শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীরা পৌঁছান টাইগারপাশ মোড়ে।
এদিকে আন্দোলনকারীরা নিউ মার্কেট মোড় থেকে সরে যাওয়ার পর সেখানে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় সেখানে তাদের সঙ্গে ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। এ কারণে আশপাশের বিভিন্ন মার্কেটে প্রায় সাত ঘণ্টা আটকা ছিলেন ছাত্রীসহ প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী। কর্তব্যরত সাংবাদিকরা বিষয়টি সেনাবাহিনীকে জানালে বিকেল পাঁচটার দিকে সেনা সদস্যের অ্যাকশনের মুখে স্থান ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ। এ সময় আবারও নিউ মার্কেট মোড়ে জড়ো হয় হাজার খানেক আন্দোলনকারী।
সন্ধ্যায় নিউমার্কেট থেকে আন্দোলনকারীরা ছড়িয়ে পড়ে নগরে বিভিন্ন স্থানে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পূর্ব থেকে ওয়াসা, লালদিঘী ও টাইগারপাশে থাকা আন্দোলনকারীরা। কারফিউ চলাকালীনই নগরের বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, দুই নম্বর গেট, আগ্রাবাদ চৌমুহনীসহ বিভিন্ন এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীরা। সর্বশেষ রাত দশটায়ও নগরের বহদ্দারহাট ও ষোলকবহর এলাকায় থেমে থেমে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো।
এদিকে রোববার সকাল ৯টা থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে পটিয়া মাদরাসার কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। তবে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের হামলায় দুপুর ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হামলায় ১১ জন গুলিবিদ্ধ হয় বলে দাবি আন্দোলনকারীদের।
পটিয়াতে কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাশেদুল ইসলাম।
এএজেড/এমআরএম