রঙিন পর্দা কাঁপানো নায়িকা থাকতেন বস্তিতে, সংসার চালাতেন হকারি করে

11 hours ago 5

ঢাকাই সিনেমার নব্বইয়ের দশকের আলোচিত নায়িকা বনশ্রী। একসময় রঙিন পর্দা কাঁপিয়েছেন এই অভিনেত্রী। কাজ করেছেন জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, রুবেল ও আমিন খানের বিপরীতে।

পর্দায় বনশ্রী নামে পরিচিত মিললেও তার মূল নাম শাহিনা শিকদার। মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ভোরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন এই চিত্রনায়িক। হাফডজনের মতো ব্যবসাসফল সিনেমার এই নায়িকার জীবনের বড় একটি সময় একেবারেই ভালো কাটেনি। দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। ছিল না মাথা গোঁজার মতো একটি আবাসস্থল। নায়িকা হয়েও থেকেছেন বস্তিতে। রাজধানীর শাহবাগের ফুল মার্কেটে ফুল বিক্রি করে সংসার চলত তার। বাসে বাসে হকারিও করতে হয়েছে তিন বেলা খাবার জোটাতে।

বনশ্রীর জন্ম শিবচরের মাদবরের চর ইউনিয়নে। ১৯৭৪ সালের ২৩ আগস্ট ওই এলাকার শিকদারকান্দি গ্রামে জন্ম তার। বাবা মজিবুর রহমান মজনু শিকদার ও মা সবুরজান রিনার দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে বনশ্রী বড়। সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন তিনি। 

ছেলেবেলা থেকেই বনশ্রী সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ফলে একসময় উদীচী গণসাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও যুক্ত হন। তিনি ভালো গান করতেন। এরপর অভিনয় শেখার জন্য যোগ দেন সুবচন নাট্য সংসদে। বিটিভির স্পন্দন অনুষ্ঠানে নিয়মিত আবৃত্তি করেছেন। এছাড়াও প্রায় দশটির মতো বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। 

এক সময় সুযোগ হয় চলচ্চিত্রে। প্রথম সিনেমার পরই রাতারাতি স্টার হয়ে যান। রুপালি পর্দার মতো তার জীবনও হয়ে ওঠে আলো ঝলমলে। তবে খুব বেশিদিন সেই সুখ ভাগ্যে টেকেনি। ১৯৯০-এর শেষে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে ছিটকে পড়েন। কাজ না পেয়ে জমা সব অর্থ শেষ হয়ে যায়। একপর্যায়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। ঠাঁই হয় বস্তিতে। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে কোথায় রাখবেন, কী খাওয়াবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। একসময় মেয়ে শ্রাবন্তীকেও হারান বনশ্রী। ছিনতাই হয়ে যায় আদরের মেয়েটি। ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়েকে এক অডিও কোম্পানির মালিক কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় বলে সে সময় অভিযোগ করেছিলেন বনশ্রী। মেয়েকে ফেরত পেতে থানা-পুলিশ করেছেন বহুবার। কোনো কাজ হয়নি। ছোট ছেলেকেও বুকে জড়িয়ে রাখতে পারেননি। অর্থাভাবে ছেলেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সংস্থায় দিয়ে দেন।

শহরে আর চলতে না পেরে এক সময় ফেরেন নিজ এলাকা মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায়। কিন্তু সেখানেও নেই কোনো ভিটেমাটি। নানা জায়গায় ঘুরে অবশেষে ঠাঁই মিলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে। ছেলে মেহেদী হাসান রোমিওকে নিয়ে সেখানেই থাকা শুরু করেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটলেও খাবেন কী! এক পর্যায়ে সরকারের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে ২০ লাখ টাকা পান বনশ্রী। সেই টাকা ব্যাংকে রেখে তার সুদ দিয়ে চলতে থাকে সংসার।

এভাবে দারিদ্র্য-অবহেলার কষাঘাতের জীবনের ইতি টানলেন এই চিত্রনায়িকা। মঙ্গলবার ভোরে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।

বনশ্রীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে শিল্পী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য সনি রহমান জানান, বেশকিছু অসুখে ভুগছিলেন এই নায়িকা। গত পাঁচ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার হৃদরোগ, কিডনির সমস্যাসহ একাধিক ব্যাধি ছিল। আজ বাদ আসর তাকে মাদারীপুর দাফন করা হবে। অনেক কষ্ট করে গেছেন বনশ্রী আপা। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।

১৯৯৪ সালে সোহরাব-রুস্তুম সিনেমার মধ্য দিয়ে রূপালি পর্দায় অভিষেক ঘটে বনশ্রীর। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে ব্যবসায় সফল হয় সিনেমাটি। পরিচিতি পান বনশ্রী। এরপর আরও এক ডজনের মতো সিনেমাতে অভিনয় করেন। 

নব্বইয়ের দশকের ‘সোহরাব-রুস্তম’, ‘মহা ভূমিকম্প’ নেশা, মহাভূমিকম্প, প্রেম বিসর্জন, ‘ভাগ্যের পরিহাস’সহ আলোচিত কয়েকটি ঢাকাই সিনেমার নায়িকা তিনি।

Read Entire Article