চলতি অর্থবছর (২০২৫-২৬) সরকার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫৫ বিলিয়ন ডলার। পণ্য রপ্তানি করে সরকার এ অর্থ আয় করতে চায়। প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ভঙ্গুর ব্যাংকখাত, বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধার মুখে পড়তে পারে, তবে অসম্ভব নয়। বিপদসংকুল পরিস্থিতি পেরিয়ে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারকে আরও কৌশলী ও বুদ্ধিদীপ্ত হতে হবে। বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, ব্যাংকখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, সরকারি সেবাদানকারী সংস্থা ও বন্দর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত চাঁদাবাজি বন্ধে অঙ্গীকার করা। এছাড়া চলমান সংস্কার উদ্যোগের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। এসব পূরণে সরকারের ব্যর্থতা রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব করতে পারে।
বিশেষ নজর দিতে হবে পোশাক খাতে
সরকার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাইলে তাদের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ দশমিক ৮৯ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে অর্জন করতে হবে। সরকার মোট ৫৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যার মধ্যে ৪৪ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার আসবে তৈরি পোশাক খাত থেকে। গত অর্থবছর তৈরি পোশাক খাত থেকে আয় হয় ৩৯ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
শিপিং লাইন ও কনটেইনার সংক্রান্ত জটিলতা অন্যতম বড় সমস্যা। এসব কারণে অনেক সময় কৃষিপণ্য যথাসময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং বিদেশি বাজারে পণ্যের উপস্থিতি ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।- প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মার্কেটিং ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল
এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে ওভেন রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ২০ হাজার ৭৯০ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া তৈরি নিট রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ১২ দশমিক ০১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ, এটা স্পষ্ট যে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকাংশেই তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। এ খাতে কোনো ধরনের সংকট বা বাধা সৃষ্টি হলে, তা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব— এমনকি আমরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি আয় করতে পারি। তবে এজন্য ব্যাংকখাতের সমস্যা, কাস্টমস সেবায় জটিলতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসুবিধা দূর করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিশোধমূলক শুল্কনীতির কারণে আমাদের জন্য অতিরিক্ত অর্ডার পাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
হাতেম আরও বলেন, ‘এছাড়া শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কম সুদের ঋণ এবং ব্যবসাবান্ধব নীতি দিতে হবে।’
কৃষিপণ্য রপ্তানিতে দূর করতে হবে অশুল্ক বাধা
কৃষিপণ্য, হিমায়িত খাদ্য ও মাছ রপ্তানি খাত আগামী অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই এ খাতগুলোতে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। ভিয়েতনাম ও ভারতের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান কিছুটা উন্নত হয়েছে, ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক গার্মেন্টস কারখানা পুনরায় চালু হচ্ছে।- বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন
সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য কৃষি ও সংশ্লিষ্ট খাত থেকে ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয় ৯৮৮ মিলিয়ন ডলার। হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ২২ দশমিক ০৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ৫৩৯ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে নির্ধারণ করা হয়েছে ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মার্কেটিং ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘কৃষিপণ্যের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার ধরা হয়েছে, যেখানে গত বছর আয় হয়েছিল প্রায় ৯৮৮ মিলিয়ন ডলার। এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব, তবে কিছু প্রতিবন্ধকতা দূর করা জরুরি।’
কামাল বলেন, ‘শিপিং লাইন ও কনটেইনার সংক্রান্ত জটিলতা অন্যতম বড় সমস্যা। এসব কারণে অনেক সময় কৃষিপণ্য যথাসময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং বিদেশি বাজারে পণ্যের উপস্থিতি ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।’
‘এছাড়া প্রতিবেশী কিছু দেশের সঙ্গে, যেমন ভারতের সঙ্গেও নানা ধরনের বাণিজ্যিক জটিলতা রয়েছে, যা কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ধরনের দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে।’
কামাল বলেন, ‘অনেক আন্তর্জাতিক বাজারে এখনো বিভিন্ন ধরনের ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বাধা রয়েছে, যেগুলো পণ্য প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে সরকারকে সক্রিয়ভাবে ট্রেড এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে শুল্ক কাঠামো সহজতর করতে হবে এবং যেসব নীতিগত জটিলতা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে।’
তিনি মনে করেন, ‘কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক চাহিদা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেই চাহিদা পূরণের সক্ষমতা রাখে, তবে এই সক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব মিলিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পরিকল্পিত পদক্ষেপ ও রপ্তানিকারকদের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে পারলে কৃষিপণ্যের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা শুধু অর্জনই নয়, বরং তা ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।’
চামড়া খাতে পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স জরুরি
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত লেদার ও লেদার গুডসের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ১ হাজার ৮৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাখায়েত উল্লাহ বলেন, ‘চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই পরিবেশগত মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে। কোনো রকম বিলম্ব না করে সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টকে (সিইটিপি) পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে হবে। অন্যথায়, খাতটি গতি হারাতে পারে এবং তা রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
সালমা ট্যানারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাখায়েত উল্লাহ বলেন, ‘চামড়া খাতে পরিবেশগত মানদণ্ড ও লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ সার্টিফিকেশন না থাকায় বৈশ্বিক ক্রেতারা অর্ডার দিচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে সেন্ট্রাল ইটিপি দ্রুত চালু ও পরিবেশগত মানদণ্ড নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায়, চামড়া খাত তার গতি হারাতে পারে। ব্যাহত হতে পারে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।’
চ্যালেঞ্জ থাকলেও ব্যাপক সম্ভাবনা
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই লক্ষ্য কিছুটা উচ্চাভিলাষী। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাভাব, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি— সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ বড়। তবে প্রযুক্তি উন্নয়ন, বাজার বহুমুখীকরণ ও লজিস্টিকস খাতের আধুনিকায়নের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। ভিয়েতনাম ও ভারতের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান কিছুটা উন্নত হয়েছে, ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক গার্মেন্টস কারখানা পুনরায় চালু হচ্ছে।’
তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাধাগুলো দূর করতে হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘাটতি, বন্দরের ধীরগতি ও শ্রমিক অসন্তোষ— এই তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে, যা ইতিবাচক দিক। তবে চলতি অর্থবছর ৫৫ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে মাসিক রপ্তানি ৫ বিলিয়নে উন্নীত করতে হবে।’
তিনি সতর্ক করেন, ‘শুধু চাহিদা থাকলেই হবে না— সরবরাহ ব্যবস্থা যদি ঠিকভাবে না চলে, তাহলে এ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। অতএব, এটি একটি সম্ভাবনার জানালা, নিশ্চিত লাভ নয়। এখন দরকার যথাযথ পরিকল্পনা ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ।
আইএইচও/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম