রবীন্দ্রসংগীত শোনা কি সত্যিই চিকিৎসা হতে পারে

1 month ago 6

সংগীতপ্রেমীদের কথা বাদই দিলাম-বাংলাদেশের কোনো মানুষ যদি সারাজীবনে একটি গান জানেন, সেটি একটি রবীন্দ্রসংগীত। তাই আজ (২২ শ্রাবণ) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮৪তম প্রয়াণ দিবসে তার গানের সম্মোহনী ক্ষমতা নিয়ে কথা না বললেই নয়।

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’

ছোটবেলা থেকে স্কুলে প্রতিদিন সকালে এই গানটি গেয়ে এবং শুনে আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতি গঠিত হয়। তাহলে ভেবে দেখুন দেশপ্রেমের অনুভূতিকে যদি একটি গান প্রভাবিত করতে পারে, তাহলে আমাদের অন্যান্য অনুভূতির ওপরেও নিশ্চয়ই সংগীতের প্রভাবকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এমনই একটি পদ্ধতি হলো মিউজিক থেরাপি বা সংগীতচিকিৎসা। শুনতে অদ্ভুত লাগছে?

শুনতে অবাক লাগলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও পরে যুদ্ধফেরত সৈনিকদের ট্রমা ও মানসিক আঘাত কাটাতে হাসপাতালে সংগীত ব্যবহার শুরু হয়। তখন দেখা যায়, লাইভ মিউজিক বা গান শুনলে রোগীদের উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং ব্যথা অনেকটাই কমে যাচ্ছে।

এই সাফল্যের পর ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশন্যাল অ্যাসোসিয়েশন ফর মিউজিক থেরাপি গঠিত হয় এবং এরপর ১৯৭১ সালে আমেরিকান মিউজিক থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই সংগীতচিকিৎসা একটি স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে বিকশিত হতে থাকে।

অর্থাৎ সংগীতচিকিৎসা বা মিউজিক থেরাপি একটি বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি, যেখানে শব্দ, ছন্দ ও সুরের মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা আনার চেষ্টা করা হয়। এটি শুধু বিনোদন নয়, বরং বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত একটি থেরাপি – বিশেষ করে উদ্বেগ, বিষণ্নতা, ঘুমের সমস্যা, আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপ (পিটিএসডি) এবং শিশুদের বিকাশজনিত সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকর বলে প্রমাণিত।

ফিরে আসা যাক রবীন্দ্রসংগীতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুধু কাব্যিক ভাব প্রকাশ নয়, বরং বহু মানুষের জন্য তা একধরনের মানসিক নিরাময়ের পথ। তার সুর ও বাণী এমনভাবে গঠিত, যা মনোজগতের গভীরে প্রবেশ করে, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা কমাতে সাহায্য করে।

রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে কি সংগীতচিকিৎসা সম্ভব

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রবীন্দ্রসংগীত ও মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে – রবীন্দ্রসংগীত শুনলে মানসিক উদ্বেগ ও বিষণ্নতার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে। গানগুলোর মধ্যে যে আত্মিকতা, তা শুনে শ্রোতা নিজেদের অনুভূতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। বিশেষ করে কবিগুরুর আধ্যাত্মিক গান ও প্রকৃতিমুখী রচনা শ্রোতাকে বাস্তব দুঃখ থেকে দূরে নিয়ে যায়, মনের ভার হালকা করে।

যেমন - ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী,’ কিংবা ‘একি লাবণ্য ছড়িয়ে দিলে’ – এই গানগুলো রূপ ও জীবনের সৌন্দর্যকে অনুধাবন করতে শেখায়, যা ডিপ্রেশন বা ট্রমায় থাকা ব্যক্তিদের কাছে নতুন আশার বার্তা দিতে পারে।

চিকিৎসকদের চোখে রবীন্দ্রসংগীত

>> ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস (সংক্ষেপে নিমহান্স) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানায়, রবীন্দ্রসংগীত বিশেষ করে ‘আধি’ ও ‘ভৈরবী’ রাগভিত্তিক গানগুলো উদ্বেগ কমাতে কার্যকর।

এ গবেষণায় ৩০ জন বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে তিন সপ্তাহ ধরে দিনে অন্তত ৩০ মিনিট রবীন্দ্রসংগীত শুনতে বলা হয়। ফলাফল অনুযায়ী, ৬৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ঘুমের উন্নতি ও মনোসংযোগ বেড়েছে।

>> নিমহান্সের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. বি.এন. মঞ্জুলার গবেষণায় উল্লেখ আছে, ট্রমা ও উদ্বেগের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক চাপ কমানোর জন্য তিনি প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় সিতার বা ভজন শোনার পরামর্শ দিয়েছেন। কম মাত্রার অ্যানজাইলিটিক (উদ্বেগ কমানোর ওষুধের) এর সঙ্গে মিলিয়ে এই থেরাপি কার্যকর তা প্রমাণিত হচ্ছে।

>> বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, যারা নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত শোনেন বা চর্চা করেন, তাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেস বা একাকীত্বের হার তুলনামূলকভাবে কম।

>> বিশেষজ্ঞদের মতে, রবীন্দ্রসংগীতের রাগ, বাণী ও ছন্দ এমনভাবে গঠিত যা মনকে শান্ত করে। ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছো অমল করে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ বা ‘আমার মাথা নত করে দাও’ – এই গানগুলো গভীর শোক, ভয় কিংবা একাকীত্বের মাঝেও মানুষকে স্থির থাকতে শেখায়।

রবীন্দ্রসংগীত কেন কাজ করে

গানের গঠন
রবীন্দ্রসংগীতের সুর সাধারণত ধীর গতি ও মৃদু ছন্দে চলে, যা মস্তিষ্কের আলফা ওয়েভ সক্রিয় করে। হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং এর মতে, আলফা ওয়েভ মানে হচ্ছে সেই তরঙ্গ যা শান্তি, রিল্যাক্সেশন ও স্বচ্ছ চিন্তাকে উদ্দীপিত করে।

কথার গভীরতা
রবীন্দ্রগানের কথা শুধু প্রেম বা দুঃখ নয়, বরং আত্মোপলব্ধি, বিস্ময়, মৃত্যুচিন্তা, আধ্যাত্মিকতা, পুনর্জন্ম – এমন সব জটিল অভিজ্ঞতার কথা বলে, যা ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসার ভাষা দেয়।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা
বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই পরিচিত, তাই মানসিক চাপের সময় এই সংগীত শোনায় একটি নিরাপদ ও পরিচিত আশ্রয়ের অনুভূতি জন্ম নেয়।

যেভাবে শুরু করবেন

১. প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে শান্ত গান শুনুন, বিশেষ করে ঘুমের আগে।

২. শুধু কান দিয়ে নয়, মন দিয়ে শুনুন – গানের কথা, সুর ও ছন্দের সঙ্গে একাত্ম হোন।

৩. কেউ কেউ নিজেই গান গাওয়া বা হামিং করেও স্বস্তি পান, এটিও কার্যকর।

৪. রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে শুরু করুন। রবীন্দ্রনাথের গান একদিকে আত্মবিশ্বাস জাগায়, অন্যদিকে মনের ভারও হালকা করে।

ট্রমা, উদ্বেগ বা বিষণ্নতা – সবক্ষেত্রেই টিকে থাকার লড়াইয়ে রবীন্দ্রসংগীত হতে পারে এক সহজলভ্য ও কার্যকর সহযোদ্ধা। শুধু চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন নয়, নিজের মনে শান্তি আনতে প্রতিদিন কিছুটা সময় রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে কাটানো যেতে পারে।

সূত্র: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ; রবীন্দ্রসংগীত গবেষণা কেন্দ্র, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়; জার্নাল অব মিউজিক থেরাপি; হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং; ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস (নিমহান্স); ডিপার্টমেন্ট অব ভেটেরান্স অ্যাফেয়ার্স, ইউএসএ

এএমপি/এমএস

Read Entire Article