ঐতিহ্য, স্থাপত্য আর শিল্পকুশলতার এক অপূর্ব নিদর্শন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অবস্থিত পোদ্দার বাড়ি। ইতিহাসের গৌরবময় অতীতকে বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটি হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ—যদি সময়মতো এর সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যায়।
ইট, ঢালাই লোহার ব্র্যাকেট, কাস্ট আয়রনের ভেন্টিলেটর ও গ্রিল, সিরামিক টাইলস, মোজাইক মেঝে আর নিখুঁত নকশার মধ্য দিয়ে পোদ্দার বাড়ির স্থাপত্য প্রকাশ করে ইউরোপীয় নান্দনিকতা ও ঔপনিবেশিক যুগের শৈলীর ছাপ। খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তী অংশে নীল-সাদার নিখুঁত ছাপ এবং কারুকাজ বাড়িটির শৈল্পিক মর্যাদা বাড়িয়ে তুলেছে আরও বহুগুণে।
দোতলাবিশিষ্ট এই বাড়িতে রয়েছে ১১০টিরও বেশি কক্ষ, যেখানে ছিল মন্দির, গোসলখানা, নাচঘর, আতুরঘর, বৈঠকখানা, খাজাঞ্চিখানা, চিত্রশালা, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ ও পান্থশালা। বাড়ির অভ্যন্তরে ছিল রমণীদের জন্য তিনদিক ঘেরা পুকুরঘাট, খাল-পুকুর দিয়ে পানি সরবরাহ, গভীর কূপ, বিশাল ফুলের বাগান ও খেলার মাঠ—যা একে পরিণত করেছে এক প্রাসাদোপম ঐতিহ্যবাহী স্থাপনায়।
স্থাপত্যের ধরনে মোগল, গ্রিক, গান্ধারা ও উপনিবেশিক যুগের ছাপের পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় কারিগরদের নিজস্ব দক্ষতার ছোঁয়া। প্রতিটি ইটে মিশে আছে ইতিহাস—যা তৈরি হয়েছে জমিদারদের নিজস্ব ইটভাটায় দক্ষ শ্রমিকের নিখুঁত পরিশ্রমে।
স্থানীয়রা জানান, পোদ্দার বাড়ির ইতিহাস প্রায় ৭০০ বছরের পুরোনো। রামমোহন পোদ্দার, শশী পোদ্দার, আনন্দ পোদ্দার ও গোপী পোদ্দার ছিলেন এ বংশের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। আনন্দ পোদ্দারের নামে গড়ে ওঠা আনন্দবাজার এখনো স্থানীয়দের কাছে পরিচিত।
৩৭২ বিঘা জমি মালিক পোদ্দারদের পুরো সম্পত্তিই অ্যাডভোকেট আউয়ালের দখলে। তার বাবা আনোয়ার হোসেন পোদ্দারদের কাজ করতেন। সেই সূত্রে পোদ্দারদের সঙ্গে সম্পর্ক। তিনি বাড়িটি কিনেছেন বলে জানা গেছে।
ঐতিহাসিক পানাম নগরীর নিকটবর্তী এ বাড়ি বর্তমানে সোনারগাঁ পৌরসভার পূর্ব ও উত্তর পাশে অবস্থিত। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শতাব্দীপ্রাচীন এ স্থাপনাটি বর্তমানে অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস প্রায়। প্রতিদিন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী দেয়াল, কার্নিশ আর কারুকার্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পোদ্দার বাড়ি যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও পর্যটনের আওতায় আনা যায়, তবে এটি হয়ে উঠতে পারে সোনারগাঁয়ের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ইতিহাসপ্রেমী দর্শনার্থীদের জন্য এটি হতে পারে এক অপূর্ব গন্তব্য, আর দেশের জন্য হতে পারে এক মূল্যবান ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার।
দায়িত্বরত কর্মকর্তা সহকারী কাস্টোডিয়ান মো. সিয়াম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘যেহেতু ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় নয়, সেহেতু এ বিষয়ে তিনি আপাতত কিছুই বলতে পারছেন না। তবে, কোনো সভা হলে এটি অধিদপ্তরের আওতায় আনা যায় কি না, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।’
এ ব্যাপারে সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা রহমান বলেন, ইতিহাসসমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন এ বাড়িটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে নতুন প্রজন্ম ইতিহাস থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে।