রাজনীতি ছেড়ে জননীতি হন

রাজনীতির ধান্দা ছেড়ে কীভাবে জননীতি হবেন, সেদিকে নজর রাখুন। খুব হয়েছে, আর কত। এ যুগে যে রাজনীতি আপনারা করেছেন, সেটা এখন জনগণ খাবে না। টাকা দেবে, নেবে, কিন্তু ভোট দেবে না। আপনি যে বাটপার, জনগণ সেটা জানে। আপনি যে দুর্নীতিবাজ, জনগণ সেটা জানে। আপনি যে মাসে মাসে চেকআপ করতে ভারত, সিঙ্গাপুর, লন্ডন যান, জনগণ সেটা জানে। আপনি যে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করেন, জনগণ সেটা জানে। জনগণ সব জেনে শুনেই আপনার পেছনে সারাদিন ঘোরে। কারণ কী জানেন। যে স্কুল থেকে আপনি পাস করেছেন, জনগণ সেই স্কুলের শিক্ষক। তারা সবকিছু জানে, তারপরও আপনার সঙ্গে থাকে। আপনি মনে করছেন আপনি নেতা, জনগণও সেটা জানে, কিন্তু দিন শেষে ফলাফলই প্রমাণ করবে আপনি কে। রাজনীতি মানে এখন আর শুধু মাইক ধরে চিৎকার করে বক্তৃতা দেওয়া নয়, মঞ্চে উঠে হ্যান করব ত্যান করব বলা নয়। সে দিন গোঁজার গিয়া। এখন রাজনীতি কথাটি ভুলে বরং বলতে চেষ্টা করুন জননীতি। জননীতি মানে মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। জননীতি মানে মানুষের ঘরে ঢোকা, তাদের পাতে হাত দেওয়া, জীবনের ঘাম বোঝা। কাগজে শব্দ সাজিয়ে ভোট চাইলে দিন পার হবে, কিন্তু ভোট আর আসবে না। মানুষ এখন কাজ চায়। এমন

রাজনীতি ছেড়ে জননীতি হন

রাজনীতির ধান্দা ছেড়ে কীভাবে জননীতি হবেন, সেদিকে নজর রাখুন। খুব হয়েছে, আর কত। এ যুগে যে রাজনীতি আপনারা করেছেন, সেটা এখন জনগণ খাবে না। টাকা দেবে, নেবে, কিন্তু ভোট দেবে না। আপনি যে বাটপার, জনগণ সেটা জানে। আপনি যে দুর্নীতিবাজ, জনগণ সেটা জানে। আপনি যে মাসে মাসে চেকআপ করতে ভারত, সিঙ্গাপুর, লন্ডন যান, জনগণ সেটা জানে।

আপনি যে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করেন, জনগণ সেটা জানে। জনগণ সব জেনে শুনেই আপনার পেছনে সারাদিন ঘোরে। কারণ কী জানেন। যে স্কুল থেকে আপনি পাস করেছেন, জনগণ সেই স্কুলের শিক্ষক। তারা সবকিছু জানে, তারপরও আপনার সঙ্গে থাকে। আপনি মনে করছেন আপনি নেতা, জনগণও সেটা জানে, কিন্তু দিন শেষে ফলাফলই প্রমাণ করবে আপনি কে।

রাজনীতি মানে এখন আর শুধু মাইক ধরে চিৎকার করে বক্তৃতা দেওয়া নয়, মঞ্চে উঠে হ্যান করব ত্যান করব বলা নয়। সে দিন গোঁজার গিয়া। এখন রাজনীতি কথাটি ভুলে বরং বলতে চেষ্টা করুন জননীতি। জননীতি মানে মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। জননীতি মানে মানুষের ঘরে ঢোকা, তাদের পাতে হাত দেওয়া, জীবনের ঘাম বোঝা।

কাগজে শব্দ সাজিয়ে ভোট চাইলে দিন পার হবে, কিন্তু ভোট আর আসবে না। মানুষ এখন কাজ চায়। এমন কাজ, যা চোখে পড়ে, হাতে লাগে, জীবনে বদল আনে। তারা আপনাকে আর প্রশ্ন করবে না, তারা জবাব দেবে ভোট দিয়ে। আর সেই জবাব শুনতে না চাইলে খোলাখুলি বলুন, আমি অতীতের মতো রাজনীতি করতে আসিনি, আমি ক্ষমতার হাট বসিয়ে ছিনতাই করতে আসিনি, আমি এসেছি জননীতি করতে, এসেছি আপনার সেবা দিতে।

অনেকেই মনে করেন জনগণ খুব সহজ। না, তারা মোটেও সহজ নয়। তারা জানে কোনটা বিলাসিতা আর কোনটা আসল সংস্কার। তারা জানে আপনার ছেলে মেয়ে দেশ বিদেশের কোথায় কোন কোর্সে পড়ছে, কোন হাসপাতালে গিয়ে নেতা সাহেব চিকিৎসা করান, কোন ব্যাংকে টাকা ঘোরে। তারা জানে কোন নেতা কখন দেশে থাকেন, কখন হঠাৎ বিদেশে উধাও হন, কার হাত দিয়ে টাকা যায় আর কেন যায়। তারা জানে কোন সিদ্ধান্ত কার স্বার্থে হয়, কোন প্রকল্প কার সুবিধার ঢাল।

এই জানা জনগণকে দুর্বল করেনি, বরং আরও সতর্ক করেছে। এখন আর কাউকে ভুল বোঝানোর সুযোগ নেই। নেতা যদি এখনও কৌতুক করতে চায়, জনগণ দাঁত কামড়ে হিসাব জমা রাখে। তারপর যদি এবার সত্যি সত্যি ভোট দিতে পারে, ভোটের দিন সব সুদে আসলে বুঝিয়ে দেবে।

জননীতি হতে হলে প্রথম শর্ত আত্মসমালোচনা। নিজের অফিস কেমন চলছে, সেটার দিকে কি আপনি কখনও ঠিকভাবে তাকিয়েছেন। আপনার আশপাশের লোকজন কাজ করে, না কি শুধু আপনার নামে ব্যবসা করে, সেটা কি খেয়াল করেন। জনগণের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার দরজা খোলা আছে, না কি সবকিছু কেবল কাগজ আর রিপোর্টেই আটকে থাকে। জননীতি মানে শুধু পোস্টার আর স্লোগান নয়। জননীতি মানে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা আর দায় নেওয়ার সাহস। এই তিনটি যদি না থাকে, তাহলে ধরে নিন আপনি পুরোনো রাজনীতির মুখে নতুন রং মেখেছেন। আর জনগণ সেই রং তুলতে বেশি সময় নেয় না।

দ্বিতীয় শর্ত সংযোগ। আপনি কি সত্যিই জানেন একজন সাধারণ মানুষের আজকের কষ্ট কোথায় গিয়ে ঠেকে। একটি পরিবারের সন্তানের স্কুল ফি বন্ধ হয়ে গেলে তাদের সংসার কোন দিকে হেলে পড়ে, সেটা কি বোঝেন। না কি আপনার কাজ শুধু বড় বড় প্রকল্পের ফিতা কাটার ছবি তোলা। জননীতি মানে বিদেশ ভ্রমণের গল্প শোনানো নয়, বড় বড় সম্মেলনের নাম ঝাড়াও নয়। জননীতি মানে প্রতিদিনের ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করা এবং সেগুলোকে রাজনৈতিক অজুহাতে চাপা না দেওয়া।

তৃতীয় শর্ত সংস্কৃতি ও নৈতিকতা। জনগণ ভালো করেই বোঝে কে ভেতর থেকে সৎ আর কে শুধু সাজগোজ করে সততার নাটক করে। আপনার জীবনে এমন কিছু আছে কি, যা মানুষ গর্ব করে অন্যকে দেখাতে পারে। না কি আপনার প্রতিটি কথা শুধু নির্বাচনের হিসাব। জননীতি করতে গেলে নিজের চলাফেরা, কথাবার্তা আর সিদ্ধান্তে এমন মান বসাতে হয়, যা মানুষ নিজের জীবনেও মানতে চায়। না হলে আপনার কথা কথাই থেকে যাবে, কাজে নামবে না।

চতুর্থ শর্ত বাস্তব অর্জন। কাগজে লেখা প্রকল্প নয়, ফাইলে বন্দি রিপোর্টও নয়। মানুষ দেখে ফল। সেবা ঠিকভাবে পৌঁছালো কি না, দুর্নীতি কমলো কি না, জীবন একটু হলেও সহজ হলো কি না। আপনি যদি বলেন কাজ করেছি কিন্তু দেখাতে না পারেন, জনগণ ভুলে যায় না। তারা ফাইল পড়ে না, তারা জীবন পড়ে। আপনার কাজ যদি মানুষের দৈনন্দিন জীবন বদলায়, তারা আপনাকে সম্মান দেবে। আর যদি না বদলায়, তাহলে যত প্রচারই চালান, ফল তত দ্রুত শুকিয়ে যাবে।

সবশেষে একটু খোঁচা দিয়ে বলি। রাজনীতি ছেড়ে জননীতি হওয়ার পথ একেবারে গোড়া থেকেই শুরু। আগে ঠিক করুন আপনার পকেট ভারী হবে, না কি জনগণের পকেট। তারপর নিজের মুখোশ খুলুন, মিশুকের ভান ছেড়ে দিন। কম কথা বলুন, বেশি কাজ করুন। দেখবেন যে ভোটকে এতদিন আপনি হালকা ভেবেছেন, সেই ভোটই একদিন আপনাকে ইতিহাসের বাতিল পাতায় ঠেলে দেবে। আর যদি চান ভোটের চেয়েও বড় কিছু, যদি চান সম্মান, তাহলে আর দেরি না করে ওসমান হাদির মতো জননীতির পথেই হাঁটুন।

ওসমান হাদির জীবনের আদর্শের কেন্দ্রে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিবাদ, ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তা এবং জনগণের সঙ্গে অটুট সংযোগ। তিনি রাজনীতিকে ক্ষমতা অর্জন বা ব্যক্তিগত সুবিধার পথ হিসেবে দেখেননি। তার কাছে রাজনীতি ছিল নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শপথ। শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে তিনি পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বাস করতেন। শিক্ষকতা, লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি মানুষের ভেতরে সচেতনতা ও প্রশ্ন করার সাহস জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন।

সব ধরনের আধিপত্যবাদ, দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল তার জীবনের মৌলিক নীতি। জীবননাশের হুমকি, সামাজিক অপবাদ কিংবা রাজনৈতিক সন্দেহ তাকে এক মুহূর্তের জন্যও থামাতে পারেনি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, একজন জননেতার প্রকৃত শক্তি আসে জনগণের ভালোবাসা ও নৈতিক সমর্থন থেকে, অর্থ বা ভয় প্রদর্শন থেকে নয়।

এই আদর্শের পথেই দাঁড়িয়ে হাদি শেষ পর্যন্ত ট্রাজেডির মুখোমুখি হন। জনগণের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠা, অর্থের বদলে মানুষের ভালোবাসায় শক্তি সঞ্চয় করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন থাকা তাকে হত্যাচেষ্টার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি শুধু একজন মানুষের ওপর হামলা নয়। এটি ছিল তার আদর্শিক অবস্থানের ওপর সরাসরি আঘাত।

এই ঘটনা কোনো আকস্মিক সহিংসতা ছিল না। যে মানুষটি অন্যায়ের সামনে কখনও নতিস্বীকার করেননি, যে মানুষটি ভয়ের রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে জনগণের শক্তিকে সামনে এনেছিলেন, তাকেই থামিয়ে দিতে চেয়েছিল সেই গুলি। হাদি দেখিয়ে গেছেন, ন্যায়ের পথে হাঁটা মানেই বিপদের মুখোমুখি হওয়া। আর সেই বিপদকে সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করাই একজন মানুষকে সময়ের সীমা অতিক্রম করে ইতিহাসে স্থায়ী করে তোলে।

জানি না তার জীবনের শেষ পরিণতি কী হবে। কিন্তু যদি তিনি ঝরে পড়েন, তবে তিনি হবেন বকুলের ফুলের মতো নীরব অথচ গভীর সুবাসে ভরা। চোখে না পড়লেও অনুভবে চিরস্থায়ী। দেহ হয়তো একদিন থেমে যাবে, কিন্তু আদর্শে তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন একজন মহান ও অমর মানুষের মতো।

রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]

এমআরএম/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow