রাজনীতি থেকে অর্থনীতিকে আলাদা রাখার দাবি ডিসিসিআই’র

2 hours ago 4

রাজনীতি থেকে দেশের অর্থনীতিকে আলাদা রাখার দাবি জানিয়েছে ঢাকার ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। সংগঠনটির পক্ষ থেকে সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেছেন, অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে আলাদা রাখতে পারলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী হতে পারবো।

শনিবার (১১ জানুয়ারি) ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের সমসাময়িক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক উপস্থাপনকালে এ অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে ডিসিসিআই’র সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী এবং সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মানসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তাসকীন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতির অবস্থা আরও খারাপ করেছে। আমরা চাই সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতি এবং রাজনীতি একই ট্রেন লাইনে না থাক। অর্থনীতি ও রাজনীতিকে আলাদা রাখতে হবে। অর্থনীতি ও রাজনীতি আলাদা রাখতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা খুবই শক্তিশালী হতে পারবো।

ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সংকটময় মুহূর্ত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে, যার মূলকারণ হলো- সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, উচ্চ জ্বালানি ব্যয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণপ্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতাসহ উচ্চ সুদহার। আমরা সুদের হার কমিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি।

বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অর্থনীতির বিদ্যমান এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোসহ বেশকিছু পণ্যের করহার বৃদ্ধি এবং শিল্পে গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর উদ্যোগ আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য করেন ব্যবসায়ীদের এ নেতা।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, উচ্চ জ্বালানি ব্যয় ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণ-প্রাপ্তিতে বাধা ও সুদের উচ্চ হার, উচ্চ শুল্ক হার, ভ্যাট হার বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি প্রভৃতি কারণে দেশের বেসরকারিখাত এমনিতেই বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।

গত তিন বছরে শিল্পে গ্যাসের দাম প্রায় ২০০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত দর কার্যকর হলে তা ৪০০ শতাংশ দর বেড়ে যাবে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এবং বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট-করহার বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। উৎপাদন ব্যাহত করবে ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমাবে। সর্বোপরি ভোক্তার ওপর চাপ বাড়বে।

ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে করে বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সরকারের পাশাপাশি স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। ব্যবসা-পরিচালন ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ কমাতে এ মুহূর্তে ভ্যাট এবং করহার বাড়ানোর উদ্যোগটি পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাই।

সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরকালে তিনি বলেন, সিএসএমই খাতে ঋণপ্রাপ্তি হলেও তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নয়, এটি বাড়াতে হবে এবং এখাতের উদ্যোক্তারা যেন সহজশর্তে ও স্বল্প-সুদে ঋণ পায়, তা নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই, কারণ আমাদের এসএমই খাত সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে থাকে।

অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কারের উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার দ্রুত এ সংস্কার কার্যক্রম লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সম্পন্ন করবে, বেসরকারিখাতের পক্ষ হতে এটি আমরা প্রত্যাশা করছি। ৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে যদি সরকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়, তাহলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আরও আশাবাদী হবেন এবং বিনিয়োগ কার্যক্রম সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

নীতির ধারাবাহিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি সহায়ক কর কাঠামো প্রাপ্তি সাপেক্ষে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হন, সেক্ষেত্রে হঠাৎ মাঝপথে কর কিংবা শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত উদ্যোক্তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যা মোটেই কাম্য নয়, ফলে স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়।

এলডিসি উত্তরণে আরও কিছুটা সময় নেওয়া যেতে পারে
এলডিসি উত্তরণ প্রসঙ্গে ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, এক্ষেত্রে আমরা অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছিলাম, তবে কোভিড মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা, স্থানীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা পরবর্তী পটপরিবর্তনসহ আর্থিক খাতে তারল্য সংকটের ফলে এলডিসি উত্তরণ মোকাবিলার প্রস্তুতি বেশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

এমতাবস্থায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমরা কতটা প্রস্তুত তা নির্ধারণে সরকারি-বেসরকারি ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে বিশদ আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। বিষয়টি যদি পেছানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, তবে দেশের সার্বিক অর্থনীতির কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার এলডিসি উত্তরণে আরও কিছুটা সময় নিতে পারে এবং এ লক্ষ্যে সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প নেই। তবে মনে রাখতে হবে ২০২৬ সালে আমাদের এলডিসি উত্তরণ হলে এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ হতে বেসরকারিখাতকে সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।

রপ্তানির বাজার বহুমুখী করতে হবে
তাসকীন আহমেদ বলেন, আমরা পোশাকখাতসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য নতুন নতুন বাজার তৈরিতে কাজ করতে চাই। পোশাকের বাজার ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সঙ্গে কাজ করবো। সেইসঙ্গে বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে আমরা কাজ করবো। আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার অ্যাগ্রো প্রসেসিং। এর পাশাপাশি হালাল পণ্য, শিপ-বিল্ডিং, খেলনা, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া, আইসিটি, অটোমোবাইল, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রপ্তানি বাড়াতে কাজ করবো আমরা।

ব্যবসা শুরুর আগেই প্রতিবন্ধকতা
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ দেশে বিনিয়োগ করতে এলে তাকে অনেক দপ্তর ও শাখার অনুমোদন নিতে হয়। দেশীয় কোনো উদ্যোক্তা উদ্যোগ তৈরিতেও বিভিন্ন ধরনের কাগজ সাবমিট করতে হয়। লোন নিতেই যদি ৩১ ধরনের কাগজপত্র লাগে তাহলে তো তা বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। আমরা চাই, এটা যেন সহজ হয়, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাবো। এটা করতে না পারলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না আবার দেশীয় বিনিয়োগও তৈরি হবে না।

প্রতি বছর ৬-৭ লাখ বেকার থেকে যাচ্ছে
তাসকীন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের মোট কর্মক্ষম জনশক্তি ৭ কোটি ৬০ হাজার। এর মধ্যে ৬ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার জন কাজে আছে। বাকি ২৫ লাখ ৫০ হাজার বেকার। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ নতুন চাকরিপ্রার্থী থাকে। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখ কাজ পায়। অর্থাৎ প্রতিবছর ৬-৭ লাখ বেকার থেকে যায়।

সিএমএসএমই’র সংজ্ঞায় গলদ
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সিএমএসএমই’র সংজ্ঞা দুইভাবে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী- সার্ভিস খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী সম্পদ (ভূমি ও বিল্ডিং বাদে) ৫০ হাজার থেকে ১০ কোটি টাকা হলে এবং কর্মী সংখ্যা ৫০ হলে, সেটি সিএমএসএমই। অপরদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংজ্ঞা অনুযায়ী- স্থায়ী সম্পদ ২ কোটি থেকে ৩০ কোটি টাকা এবং কর্মী সংখ্যা ৫১ থেকে ১২০ জন থাকলে সেটি সিএমএসএমই।

একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী- বিজনেস খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী সম্পদ (ভূমি ও বিল্ডিং বাদে) ৫০ হাজার থেকে ১০ কোটি টাকা হলে এবং কর্মী সংখ্যা ৫০ হলে, সেটি সিএমএসএমই। অপরদিকে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুযায়ী- কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী সম্পদ (ভূমি ও বিল্ডিং বাদে) ১ কোটি ৫০ লাখ থেকে ২০ কোটি টাকা এবং কর্মী সংখ্যা ১৫০ হলে সেটি সিএমএসএমই। অপরদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংজ্ঞা অনুযায়ী- ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে স্থায়ী সম্পদ ১৫ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা এবং কর্মী সংখ্যা ১২১ থেকে ৩০০ জন থাকলে সেটি সিএমএসএমই। এছাড়া আরএমজি অথবা শ্রম নিবিড় শিল্পের ক্ষেত্রে স্থায়ী সম্পদ ১৫ থেকে ৫০ কোটি এবং কর্মী-সংখ্যা ১ হাজারের বেশি হলে সেটি সিএমএসএমই।

সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, এমনিতেই আমাদের জিডিপিতে করের অবদান বেশ কম। এরূপ পরিস্থিতিতে বিদ্যমান অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেইসঙ্গে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না নেওয়া এবং এডিপি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার পাশাপাশি সময়মতো প্রকল্প সমাপ্তিতে নজরদারি বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।

এমএএস/এমএএইচ/

Read Entire Article