১৯ জুলাই ২০২৪। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুরে চার বছরের দুরন্ত আব্দুল আহাদকে ঘুম পাড়িয়েছিলেন তার মা। কিন্তু বিকেল ৪টার দিকে বাইরে হঠাৎ বিকট আওয়াজে ঘুম ভাঙে ছোট্ট আহাদের। বিছানা থেকে নেমে সে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়, ৮ তলা ভবনের ওপর থেকে নিচে কী ঘটছে তা দেখার জন্য। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা-মায়ের মাঝখানে ঢুকে নিচের দিকে দেখার চেষ্টা করছিল সে।
মুহূর্তেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ানো আহাদ গুলিবিদ্ধ হয়—একটি গুলি তার ডান চোখ ভেদ করে মাথার ভেতর ঢুকে যায়। বাবা আবুল হাসান শান্ত (৩৩) ও মা সুমি আক্তার সন্তান লুটিয়ে পড়তেই ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নেন। শুরু হয় আহাদকে বাঁচানোর প্রাণান্ত চেষ্টা। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে, পরদিন না ফেরার দেশে পাড়ি জমায় ছোট্ট আহাদ।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী সে–ই।
আমরা জাতি হিসেবে কতটা নিচে নেমে গেছি, তা আজ স্পষ্ট। এতগুলো সন্তান প্রাণ হারালো, তবুও আমাদের কারও ভেতর সহানুভূতি নেই। কেউ কারও কষ্ট অনুভব করে না। চারদিকে শুধু চাঁদাবাজি, চুরি আর ছিনতাই—ক্ষমতা দখলের জন্য চলছে হানাহানি আর প্রতিহিংসা।–শহীদ আহাদের বাবা
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ওই আন্দোলনে অন্তত ১৩০ জন শিশু (১৮ বছরের কম বয়সী) শহীদ হয়েছে। এদের মধ্যে ১১ বছরের নিচে রয়েছে অন্তত ছয়জন। যারা রাজনীতি কী সেটাই বুঝতে শেখেনি। তবু রাজনৈতিক সহিংসতার বলি তারা।
আহাদের বাবা আবুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার আহাদ তো মাত্র চার বছরের শিশু। রাজনীতি কী, তা বুঝতেই শেখেনি। আমি নিজেও সরকারি চাকরিজীবী, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনোদিন যুক্ত হইনি। তবুও রাজনীতির এই সহিংসতার বলি হতে হলো আমার নিরপরাধ শিশুকে। এ ব্যথার কোনো সান্ত্বনা নেই।’
তিনি বলেন, ‘সেসময় ছোট্ট ছোট্ট শিশুরাও ঘরের ভেতর নিরাপদ ছিল না। আমার আহাদ ছিল ঘরের মধ্যে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুধু তাকিয়েছিল—সেই চাহনিতেই তার জীবন শেষ হয়ে গেলো।’
আহাদের বাবা বলেন, ‘আমার বড় ছেলের বয়স ১২ বছর। তার জন্মের পর আমার স্ত্রী গ্রামে ছিল। আমি ঢাকায়। কিন্তু আহাদের জন্মের পর আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম। আহাদকে খুব যত্ন করে বড় করেছি। ওর প্রতিদিনের আবদার, আদর সবকিছুই খুব মিস করি। আসলে এই অনুভূতি কাউকে বোঝানোর মতো নয়।’
মর্গে ঢুকে দেখি—স্তূপ করে রাখা ৩০-৪০টা লাশের ওপরে পড়ে আছে আমার হোসেনের নিথর দেহ। সে দৃশ্য কোনো মায়ের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।–শহীদ হোসেনের মা
যে দেশের জন্য সন্তান রক্ত দিয়েছে সে দেশকে এখন কেমন দেখছেন—জানতে চাইলে ঢাকার সেগুনবাগিচার কর অঞ্চল-৮ কার্যালয়ের এই উচ্চমান সহকারী বলেন, ‘আমরা জাতি হিসেবে কতটা নিচে নেমে গেছি, তা আজ স্পষ্ট। এতগুলো সন্তান প্রাণ হারালো, তবুও আমাদের কারও ভেতর সহানুভূতি নেই। কেউ কারও কষ্ট অনুভব করে না। চারদিকে শুধু চাঁদাবাজি, চুরি আর ছিনতাই—ক্ষমতা দখলের জন্য চলছে হানাহানি আর প্রতিহিংসা। মানুষ হারিয়ে ফেলেছে মানবতা।’
- আরও পড়ুন
বিচারের অপেক্ষায় সিলেটের ৭ শহীদ পরিবার
‘আব্বু, শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় নাই’ শেষ কথা ছিল শহীদ আব্দুল্লাহর
চোখের সামনে একের পর এক হত্যা দেখে ভেঙে পড়েন সাংবাদিকরা
পুলিশের গুলিতে ‘নিহত’ হৃদয়ের মরদেহ খুঁজে ফিরছে পরিবার
নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকায় নিজ বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট রিয়া গোপ। চলছিল আন্দোলন। হঠাৎ একটি গুলি এসে বিদ্ধ করে তাকে—পাঁচতলা ভবনের ছাদও তাকে বাঁচাতে পারেনি।
রিয়া ছিলেন দীপক কুমার গোপ ও বিউটি ঘোষ দম্পতির একমাত্র সন্তান। বিয়ের প্রায় চার বছর পর জন্ম নিয়েছিল সে, পরিবারের অনেক কাঙ্ক্ষিত আলো হয়ে।
‘আমি বিএনপি করি না, আওয়ামী লীগও না। কিন্তু আন্দোলনে বাচ্চারা মারা যাচ্ছিল, ঘরে বসে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। তাই পরিবারের সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের লংমার্চে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।-শহীদ জাবিরের মা
রিয়ার মামা রাজেশ গোপ জাগো নিউজকে বলেন, ‘একমাত্র সন্তানের জীবনের বিনিময়ে দীপক-বিউটি কারও কাছ থেকে এক পয়সাও সাহায্য নেননি। আবারও সন্তানের আশায় আছেন, কিন্তু স্রষ্টা এখনো তাদের কোল পূর্ণ করেননি। তাদের কষ্ট এমন, যা চোখে না দেখলে বোঝা যায় না।’
পপকর্ন ফেরি করতে গিয়ে গুলবিদ্ধ হয় হোসেন
২০ জুলাই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রাম রোড এলাকায় ফেরি করতে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারায় ১২ বছরের হোসেন মিয়া। পপকর্ন, আইসক্রিম আর চকলেট বিক্রি করেই পরিবার চালাতো সে।
বিকেল থেকেই নিখোঁজ হোসেনকে খুঁজছিলেন তার মা মালেকা বেগম ও বাবা মানিক মিয়া। রাত ৯টার দিকে মোবাইলফোনে একটি ছবি দেখে নিশ্চিত হন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হোসেনকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে।
গাড়ি না থাকায় প্রথমে একটি পিকআপে করে যাত্রাবাড়ী, পরে এক রিকশাওয়ালার সহায়তায় রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছান তারা।
মালেকা বেগম বলেন, ‘মর্গে ঢুকে দেখি—স্তূপ করে রাখা ৩০-৪০টা লাশের ওপরে পড়ে আছে আমার হোসেনের নিথর দেহ। সে দৃশ্য কোনো মায়ের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে তার বয়স ১০ বছর লেখা হয়েছে। কিন্তু হোসেনের বয়স ছিল ১২। তবে রাজনীতি বোঝার মতো ছিল না। সে শুধু ছাত্রদের সঙ্গে গিয়েছিল। তাই বলে তার বুকে গুলি করবে?’
রাজনীতির নামে প্রাণ হারানো একমাত্র সন্তানের জন্য এখনো বিচার তো দূরের কথা, একটি আসামিও গ্রেফতার হয়নি বলে ক্ষোভ জানান তিনি।
আসামিদের হুমকিতে পরিবারসহ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য মালেকা বেগম বলেন, ‘একটা আসামিও এখনো ধরা পড়েনি। উল্টো তারা আমাদের বাড়িতে এসে মামলা তুলে নিতে বলে, চাপ দেয়। পুলিশ কিছুই করে না। ফলে হোসেনের স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ি ছেড়ে আমরা এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে আশ্রয় নিয়েছি।’
৫ আগস্ট ২০২৪। রাজধানীর উত্তরায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ চলাকালে মা–বাবার সঙ্গে ‘মিছিল দেখতে’ গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় ছয় বছরের জাবির ইব্রাহিম।
জাবিরের মা রোকেয়া বেগম মঙ্গলবার সকালে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বিএনপি করি না, আওয়ামী লীগও না। কিন্তু আন্দোলনে বাচ্চারা মারা যাচ্ছিল, ঘরে বসে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। তাই পরিবারের সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের লংমার্চে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। জাবিরকে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু ও জিদ করতে থাকে। বাধ্য হয়ে তাকেও সঙ্গে নিই।’
তিনি বলেন, ‘ততক্ষণে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার খবর আসে। রাস্তায় আনন্দ মিছিল চলছিল। আন্দোলনকারীরা মিষ্টি বিতরণ করছিল। আমরা এক নির্মাণাধীন ভবনে দাঁড়িয়ে তা দেখছিলাম। জাবির আরও কাছ থেকে মিছিল দেখতে চায়। ঠিক তখনই হঠাৎ পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। সবাই দৌড়াতে থাকে। জাবিরের বাবা ওর হাত ধরে ছিলেন। এর মধ্যেই একটি গুলি এসে লাগে জাবিরের উরুতে।’
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরও শেষ রক্ষা হয়নি। মারা যায় রোকেয়া বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, ছয় বছরের জাবির।
মৃত্যুবার্ষিকীতে জাবিরের স্কুল—কেসি স্কুল অ্যান্ড কলেজ—একটি স্মরণসভার আয়োজন করে। মোবাইলে কথা বলার সময় রোকেয়া বলেন, ‘স্কুলে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছি। কিন্তু কীভাবে যাবো বুঝতে পারছি না। আমার পা যেন থেমে গেছে।’
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মতো অনেক মায়ের সন্তানের রক্তের বিনিময়ে দেশে পরিবর্তন আসার কথা ছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। ঠিক যেন মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ।’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে আমাদের বহু সন্তান প্রাণ দিয়েছে। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এ দেশের রাজপথ। কিন্তু কিছু … কারণে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।’
‘দুঃখজনক ব্যাপার। যেভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে নির্বিচারে… সেই ক্ষোভেই মানুষ নেমেছে। শিশুদের স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল থাকে। বাড়িতে ছাদে বারান্দায় ছিল। গুলি কাউকেই করা উচিত নয়।’
মানবাধিকার কর্মী খুশি কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর আন্দোলন দমাতে তৎকালীন সরকার যা করেছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়, অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও দমনমূলক আচরণই ওই সরকারের দ্রুত পতনের অন্যতম কারণ।’
‘তবে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা কাঠামো এখনো ভয়াবহ রকমের দুর্বল। এখনো এমন কোনো নীতিগত কাঠামো গড়ে ওঠেনি, যে কারণে স্কুলপড়ুয়া শিশুরা নিরাপদ নয়, কিংবা মানুষকে উসকানি দিয়ে মব সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে,’ বলেন তিনি।
শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে এখনো আমরা পর্যাপ্ত সচেতন নই। হয়তো পুলিশ আগের মতো এলাপাথাড়ি গুলি করছে না। আকারে হচ্ছে না, কিন্তু এখনো শিশুদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, প্রমাণ ছাড়াই তাদের আটক রাখা হচ্ছে বা জেলে পাঠানো হচ্ছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক,’ বলেন খুশি কবির।
জেপিআই/এএসএ/জেআইএম