সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাবার্তায় খিঁচুনি-ভ্যাঙচি, খোঁচা, সর্বোপরি গালমন্দে মানুষ কত বিরক্ত ছিল তিনি নিজে হয়তো জানেন না। জানার দরকারও মনে করেননি। বা এখনো জানেন না। হিতাকাঙ্ক্ষীদের কেউ তাকে কখনো তা জানিয়েছেন বলেও তথ্য নেই। খেলা হবে, খেলা হবে; তলে তলে ঠিক হয়ে গেছে –এ ধরনের ভাঁড়ামিতে সেকেন্ড ইন কমান্ড ওবায়দুল কাদের বা হাছান মাহমুদরাও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সর্বনাশ কম করেননি। কথায় কথায় প্রতিপক্ষকে নিম্নমানের শব্দ-বাক্যে তাচ্ছিল্য করে কাদের, হাছান, ইনু, হানিফরা নিজেরা একটা পর্যায়ে স্রেফ ক্লাউনে পরিণত হয়েছেন। পরে তো দলবলশুদ্ধই বিতাড়িত।
এসব তো মাত্র বছরখানেক আগের ঘটনা। এখন কী হচ্ছে? জুলাই বিপ্লবীদের হেদায়েত করতে গিয়ে সেদিন ঘটনা চক্রে দৃশ্যপটে আগমন এক সময়ের তুখোড় নেতা, সাবেক মন্ত্রী, প্রয়াত মানিক মিয়ার পুত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর। ছেলেপেলেগুলোর ভাষা-আচরণ, স্লোগানে, বর্তমান সরকারের ভূমিকায় কী মাত্রায় অপমানিত বোধ করছেন, তা বলছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে বলেন, এবার যেভাবে অপমান করা হয়েছে, এটি ইতিহাসে লেখা থাকবে।
অবাক, বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, উপর্যুক্ত কথাগুলোর ফাঁকে তিনি নিজেও এমন সব শব্দ-বাক্য যোগ করেছেন, যা লেখা বা ছাপার অযোগ্য। প্রযুক্তির কল্যাণে সোশ্যাল মিডিয়ায় রিল হয়ে ঘুরছে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথাগুলো। ওই সময় তাকে কেউ বারণ করেননি এসব শব্দ উচ্চারণ না করতে। বরং তৃপ্তি পেয়েছেন, হাত তালি দিয়েছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত জোয়ান-বুড়ারা। জাতীয় পার্টি থেকে বিতাড়িত বা দলছুটদের গত শনিবার রাজধানীর ইমানুয়েল কনভেনশন সেন্টারে সম্মেলনে এসেছিলেন তিনিও।
গালাগাল সমাজের রাজনীতি, সংস্কৃতি, আমাদের বিশ্বাস, সংস্কার, আমাদের আপ্ত ধারণাগুলোকে প্রকাশ করছে। সামগ্রিকভাবে তা একটি প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছে রসাতলে। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যাচ্ছে তা আর জোয়ান-বুড়ার ফের মানছে না। গালি বা নিম্নমানের শব্দ-বাক্য ব্যবহারে সব বয়সীর মাঝে এ প্রবণতা এক বিকারগ্রস্ততা।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের জোট শরিক জেপির (মঞ্জু) চেয়ারম্যান ও দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সহিংসতার ঘটনায় পাঁচটি মামলার আসামির তালিকায় নাম রয়েছে মঞ্জুর। ছাড়া পাওয়ার পর থেকে আড়ালে আবডালেই ছিলেন তিনি। সেদিন হঠাৎ প্রকাশ্যে এসে বোমা ফাটালেন কতগুলো নোংরা শব্দে, যা কিছুটা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের শরিক কিছু তরুণের মতোই।
কী দরকার পড়লো তার মতো প্রবীণের এ উদাম-নোংরা দৌড়ে যোগ হওয়া। গেলো কিছুদিন ধরে আমাদের আগস্ট আন্দোলনের বিজয়ী সোনামণিদের জানান দেওয়া যে, প্রবীণরাও পারেন? রাজনীতিতে গালিগালাজ, কদাকার-নোংরা শব্দের পরিণাম তো সবাই দেখেছে। গজবের মতো এর কেন নতুন চাষাবাদ? তাও আবার এক সময়ের সেই মার্জিত-সাহসীদের দিয়ে নতুন করে পোড়াপত্তন! স্কুলশিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র মেরামত আন্দোলনের স্লোগান কী মার্জিত-রুচিসম্মত- সৃজনশীলই না ছিল। ‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমিই বাংলাদেশ’, যা মানুষের চিন্তা জগৎ নাড়িয়ে দিয়েছিল।
সেই ধারাবাহিকতায় রক্তাক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্লোগানও ছিল বুদ্ধিদীপ্ত। ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ ‘চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে, হয়ে গেলাম রাজাকার’। ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’। ‘বন্দুকের নলের সাথে ঝাঁজালো বুকের সংলাপ হয় না’। সেই প্রজন্মই এখন কীসব শব্দ ছুড়ছে অহরহ? মস্তিষ্কে ঝড় তুলে দেওয়া এসব স্লোগানের পর এখন অশ্লীলতা-রুচিহীনতার পথে হাঁটছে কেন? দৃশ্যত কোনো পথপ্রদর্শক কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।
রাজনীতিতে রুচিহীনতা বা অশ্লীলতা দিয়ে সস্তা দরে মাঠ কাঁপানো যায়। কিন্তু, মানুষ তা কোনোকালেই গ্রহণ করেনি। ক্ষণিক সময়ের জন্য নোংরামিতে হাইপ তুলে ভাইরাল হওয়া এক জিনিস, আর প্রসিদ্ধি পাওয়া আরেক জিনিস। দিনশেষে রাজনীতিতে শিষ্টাচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার। নেতার মধ্যে শিষ্টাচার থাকলে তার কর্মীরাও সভ্য হয়। দলীয় ক্ষমতার মোহে কাউকে গালিগালাজ করলেই বড় হওয়া যায় না। বড় জোর কয়েকদিন আলোচিত হওয়া যায়। প্রতিবাদ অসভ্য ভাষায় কার্যকর হয় না। এতে মর্যাদা-সম্মান আগে নিজেরটা নষ্ট হয়। আর নিজের বা কারও সম্মানবোধ না থাকলে তো কথাই নেই।
রাজনীতিতে পক্ষে-বিপক্ষে অথবা ভিন্নমত থাকবে। এটা রাজনীতির সৌন্দর্য, শিষ্টাচার। কিন্তু, হালে নতুন উদ্যমে ভিন্নমতকে গালিগালাজের এক বিকৃত-ধিকৃত চর্চা শুরু হয়েছে। তা মিছিলে, মিটিংয়ে, স্লোগানে। উচ্চারণের, লেখার অযোগ্য এসব অকথ্য শব্দ ন্যূনতম সুস্থ সমাজে কেবল বেমানান নয়। বরং চরম অসভ্যতা। গালিগালাজকে রাজনীতির এ স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে আসা আগামীর জন্য খুব অশনি সংকেত। কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ অসামাজিকতায় কেবল শরিক নয়, মদতও দিচ্ছে।
এসব প্ল্যাটফর্ম এখন বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। কাউকে অপদস্থ করার উপযুক্ত মাধ্যমটির দিকে বেশ জোক কারও কারও। সম্মিলিতভাবে তারা দেশকে গালমন্দ ও ঘৃণা চাষের উর্বর ভূমি করে তুলছে। তা করতে গিয়ে সুস্থ আলোচনা, শালীন বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি যুক্তির চেয়ে এখন বিতর্কিত কোনো একটি তকমা লাগানো, অশালীন ভাষার আমদানি, অর্ধসত্য বা খণ্ডিত তথ্যের প্রচার-প্রসার। সেখানে যুক্তির চেয়ে গালিগালাজ, মতবিরোধের জায়গায় অপমান, আর ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধার বদলে বিদ্বেষ।
গালাগালের নোংরামির মধ্যে যেটা সবচেয়ে প্রকট সেটা হলো যার প্রতি এটি উচ্চারিত হয় তার প্রতি রাগ, ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের প্রকাশ। আরও একটা বিষয় একটু প্রচ্ছন্ন, সেটা হলো যাকে গাল দেওয়া হয় সে লোভী, ইতর, অধঃপতিত, অনভিজাত, মূর্খ, অপরাধী এবং হিংস্র, অসভ্য, অযোগ্য ইত্যাদি। গালাগাল সমাজের রাজনীতি, সংস্কৃতি, আমাদের বিশ্বাস, সংস্কার, আমাদের আপ্ত ধারণাগুলো প্রকাশ করছে। সামগ্রিকভাবে তা একটি প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছে রসাতলে। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যাচ্ছে তা আর জোয়ান-বুড়ার ফের মানছে না। গালি বা নিম্নমানের শব্দ-বাক্য ব্যবহারে সব বয়সীর মাঝে এ প্রবণতা এক বিকারগ্রস্ততা।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএফএ/জিকেএস