আওয়ামী লীগের আমলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র ছিলেন এএইচএম খায়রুজ্জামান (লিটন)। এসময় তিনি প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কাজে হাত দেন। সিটি করপোরেশনের কম এলাকাতেই এত বিপুল পরিমাণ অর্থে চলে উন্নয়ন কাজ। কিন্তু এর আড়ালে শুরু হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমি দখল।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার দাপটে অন্তত চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করে নির্মাণ কাজ করেছেন সাবেক এই মেয়র। এজন্য নেওয়া হয়নি কোনো অনুমতি। এমনকি লিখিত আবেদনের পরও থামেনি কাজ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সে সময় ভয়ে তারা কিছু বলতে পারেননি। এখন তারা আপত্তি জানাচ্ছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, নিময় মেনে এসব কাজ করা দরকার। যদি নিয়মের ব্যত্যয় হয়, তাহলে বাকি কাজ আইনি প্রক্রিয়া মেনে শেষ করা হবে।
রাসিক সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় একটি প্রকল্প অনুমোদন পায়। যার নাম ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্প। এজন্য ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার কোটি টাকা।
- আরও পড়ুন
- অবৈধ অনুমোদনে পাঁচ বছরে রাসিক হাতিয়েছে ২৬ কোটি টাকা
- সপরিবারে দেশ ছাড়লেন রাসিক মেয়র লিটন
- বন্ধ হচ্ছে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৯ বিভাগ
প্রকল্পের আওতায় মোট ২২৯টি প্যাকেজের ২ হাজার ৫০ কোটি ৩ লাখ টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এরমধ্যে এক হাজার ৯৭৬ কোটি ২২ লাখ টাকার কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। মোট ২২৯টি প্যাকেজের মধ্যে ১৮৩টি প্যাকেজের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর ৪৬টি প্যাকেজের কাজ চলমান। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৬০ শতাংশের অধিক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকা মাত্র ৯৪ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু এই এলাকাতেই আছে অনেকগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জমি ও সীমানা নির্ধারিত আছে। কিন্তু সাবেক মেয়র এএইএম খায়রুজ্জামানের দাপটে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের জমি হারিয়েছে।
সবশেষ উক্ত প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ভেতর দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে ফ্লাইওভার। কিন্তু এই জমি ব্যবহারের জন্য কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। এমনকি মেডিকেল কলেজের গাছও কেটে দেয় সিটি করপোরেশন।
উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের একটি অংশ, যা এখনো চলমান
একই অবস্থা রাজশাহী কলেজেরও। তাদের প্রাচীর ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে সাহেব বাজার থেকে কোর্ট পর্যন্ত সড়ক। অপরদিকে রাজশাহী মহিলা কলেজের দেওয়াল ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে চালপট্টি থেকে বর্ণালী হলের মোড়ের পেছনের রাস্তা।
- আরও পড়ুন
- সড়ক সাজাতে গিয়ে সাড়ে ৪৩ কোটি টাকা বিল বাকি রাসিকের
- রাজশাহীর উন্নয়নে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প
এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়াল ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে কাজলা থেকে কড়ইতলা ও বিনোদপুর পর্যন্ত সড়ক। এসব প্রতিষ্ঠানের জমি ব্যবহার হলেও নেওয়া হয়নি কোনো অনুমতি।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. খন্দকার মো. ফয়সল আলম বলেন, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমি আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান নিতেই পারে। তবে এজন্য অনুমোদন লাগে। আর মেডিকেল কলেজ যেহেতু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে তাই এর মালিক তারাই। আমরা লিখিত আপত্তি জানিয়েছি। কিন্তু বাধা দিতে পারি না। কারণ একনেকে পাস হয়েছে প্রকল্পটি। আর সেখানে সচিবরাই অনুমোদন দিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের দাবির প্রেক্ষিতে ফ্লাইওভারের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে কয়েক দফায় তাদের নিয়ে আলোচনায় বসে সিটি করপোরেশন। এসময় ছাত্ররা কলেজের জমির ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার করতে দিতে রাজি হননি। কিন্তু পরবর্তীতে হোস্টেল ও গ্যাসের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে এখনো এসব বাস্তবায়ন হয়নি, প্রক্রিয়াধীন আছে। আর গাছ কাঁটার বিষয়টি জানা নেই।
অপরদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সালেহ হাসান নকীব বলেন, জমিটি কীভাবে নেওয়া হয়েছে জানা নেই। তবে জমি ব্যবহারের বিষয়টি নজরে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। যদি নিয়ম মেনে না নেওয়া হয়, তবে ব্যবস্থা নেবো।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) রাজশাহী গবেষণাগারের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং পরিচালক ড. মো. সেলিম খান বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানটি কেপিআই। এরপরও এটি ভাঙতে চেয়েছিল সিটি করপোরেশন। তখন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছিল। সেসময় তৎকালীন মন্ত্রী লিটনকে ধমক দিয়ে (কাজ থেকে) সরিয়ে নেন। তবে এখন সমস্যা হচ্ছে। তারা রাস্তা উঁচু করায় আমাদের দেওয়াল নিচে পড়ে গেছে। আমরা আনসার বাড়িয়েছি। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কেও জানিয়েছি।
রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. জুবাইদা আয়েশা সিদ্দীকা বলেন, অন্য প্রতিষ্ঠানে যেভাবে জমি নিয়েছে আমাদেরও সেভাবে নিয়েছে। তারা আমাদের চিঠি দিয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় জমি দিতে কোনো অনুমতি দেননি। এরপরও তারা নিয়েছে। এখন কীভাবে নিয়েছে সেটি আপনারা সিটি করপোরেশনের কাছেই জানতে চান।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মু. যহুর আলী বলেন, রাজশাহী কলেজের হোস্টেলের সামনে রাস্তা সংস্কারের জন্য বেশ কিছু জমি সিটি করপোরেশন নিয়েছে। তবে এটি নিয়ম মেনেই নিয়েছে বলে জানি। তবে জমি অধিগ্রহণের কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি এই অধ্যক্ষ।
এদিকে গত ৫ আগস্টের পর লিটন ও তার পরিবারের সদস্যরা পলাতক রয়েছেন। তাই তাদের কারো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এসব বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন বলেন, প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানই তাদের জমি ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। অন্যের জমি ব্যবহার করা উচিত নয়। যদি রাজশাহী সিটি করপোরেশন কোনো জমি ব্যবহার করে থাকে সেটি দেখা হবে। নিয়ম মেনেই নির্মাণ করা উচিত।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ বলেন, কোনো জমি ব্যবহার করলে নিয়ম মেনেই করতে হয়। এখন আমারও তো প্রশ্ন কীভাবে হলো। তবে বিষয়টি যখন জানালেন খোঁজ নিচ্ছি।
সাখাওয়াত হোসেন/জেডএইচ/জিকেএস