রাজশাহীর সেই পাহাড়িয়াদের ‘উচ্ছেদের’ অভিযোগ ভুয়া

1 day ago 4

তদন্তে সাজ্জাদই জমির প্রকৃত মালিক শনাক্ত
জোর করে উচ্ছেদ ও ভয়ভীতির প্রমাণ নেই
সাড়ে ২৭ লাখ টাকা নিয়েছেন পাহাড়িয়ারা
উৎসব করে উচ্ছেদ নয়, সম্মতিতে পিকনিকের আয়োজন

রাজশাহীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পাহাড়িয়া সম্প্রদায়কে কথিত উচ্ছেদের ঘটনা নতুন মোড় নিয়েছে। তদন্তে সাজ্জাদ আলীই জমির প্রকৃত মালিক বলে শনাক্ত করা হয়েছে। সাজ্জাদের বিরুদ্ধে জোর করে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ, বল প্রয়োগ বা ভয়-ভীতি প্রদর্শনেরও প্রমাণ মেলেনি।

সহকারী কমিশনারের (ভূমি) তদন্তে উঠে এসেছে, পাহাড়িয়া সম্প্রদায় তাদের সপক্ষে জমির মালিকানা সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তবে সাজ্জাদ আলী মালিকানা দাবির পক্ষে রেকর্ড, দলিল, নামজারি ও ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের প্রমাণ দেখিয়েছেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমাও দিয়েছেন এসিল্যান্ড।

পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবারকে ‘খাসি খাইয়ে’ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে—এমন খবর কয়েকটি গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাকে প্রচার করা হয়। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। স্থানীয় কয়েকটি এনজিও ছাড়াও ঢাকা থেকে মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা এসে নানা তৎপরতা শুরু করেন। প্রচার করা হয়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় কথিত এই উচ্ছেদের ঘটনা তদন্তে নামে বোয়ালিয়া থানা ভূমি অফিস।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর হড়গ্রাম নতুনপাড়া এলাকায় একখণ্ড জমির ওপর স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে থেকেই বসবাস করছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পাহাড়িয়া সম্প্রদায়। প্রথমে মাত্র ছয়টি পরিবার বসবসা শুরু করে। পরে বাড়তে বাড়তে সেখানে এখন অন্তত ১৬টি পরিবার অস্থীয় ঘরবাড়ি করে বসবাস করছে। কিন্তু জমির মালিক তারা নন। অন্যের জমিতে বাস করে আসছেন। তাদের বাড়িঘেঁষা বাকি জমির মালিক সাজ্জাদ আলী নামের এক ব্যক্তি।

তবে সাজ্জাদ আলীর দাবি, পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের বসতির ৩৭ শতক জায়গাও তার কেনা সম্পত্তি। কিন্তু সম্প্রতি ওই জায়গা ফাঁকা করে দিতে পাহাড়িয়াদের অনুরোধ জানান সাজ্জাদ। তারা অন্যত্র চলে যেতে রাজিও হন। তবে সহায়-সম্বল না থাকায় মানবিক কারণে বসবাসের জন্য তারা সাজ্জাদ আলীর কাছে পাঁচ কাঠা জমি দাবি করেন। কিন্তু সাজ্জাদ আলী জমি নয়, পুনর্বাসনের জন্য তাদের টাকা দিতে রাজি হন। এসময় পাহাড়িয়া সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে ৫০ লাখ টাকা সহায়তা দাবি করে। পরে উভয়পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে তিন মাসের মধ্যে জমি ছেড়ে দিতে রাজি হন তারা।

অন্যদিকে, পুনর্বাসনের জন্য পরিবারগুলো মোট ৩০ লাখ টাকা দিতে রাজি হন সাজ্জাদ। সাজ্জাদ আলীর কাছ থেকে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের কে কত লাখ টাকা করে নিয়েছেন স্ট্যাম্পে প্রত্যেকের সই-টিপসহি রয়েছে।

পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের মোড়ল বাবলু পাহাড়িয়া বলেন, ‌‘বাপ-দাদার সময় থেকে আমরা এখানে বসবাস করছি। কিন্তু জমির মালিকানার কোনো কাগজপত্র আমাদের নেই। সাজ্জাদের কাগজপত্র আছে বলে বাউন্ডারি প্রাচীর দিয়েছে। আমাদের কাগজ নেই। কাজেই থাকার সুযোগ নেই। এটাই আমরা ভেবেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চলে যাওয়া শুরু করেছিলাম। আমাদের কাগজপত্র নাই। ডকুমেন্ট নাই। আমরা কোথাও জিততে পারবো না। আমাদের কারণে সাজ্জাদ হাজির জমির ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখানে বসবাস করার কারণে কেউ জমিটা নিতেও চায় না। সাজ্জাদের অনুরোধে আমরা সরে যেতে রাজি হই। আমরা বলেছিলাম, পাঁচ কাঠা জমি দিতে। কিন্তু সাজ্জাদ হাজি বলেছে, জমি দিতে পারবো না, টাকা দিয়ে সহযোগিতা করবো। আমরা তার কথামতো সব বুঝেসুঝেই সরে যেতে চেয়েছিলাম। কথামতো সাজ্জাদ আমাদের টাকাও দিয়েছে।’

গৃহবধূ রেবতী বিশ্বাস বলেন, ‘এই জমির মালিক সাজ্জাদ। তিনি বাউন্ডারিও দিয়েছেন। আমাদের থাকতে দিয়েছিলেন। এখন চলে যেতে বলেছেন। টাকাও দিয়েছেন। কিন্তু এত কম টাকায় কী হবে? আমার কোথায় যাবো? জায়গাটার ওপর আমাদের মায়া পড়ে গেছে।’

রাজশাহীর সেই পাহাড়িয়াদের ‘উচ্ছেদের’ অভিযোগ ভুয়া

এদিকে, এসিল্যান্ডের তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, বোয়ালিয়া ভূমি অফিসে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের পাঁচজন প্রতিনিধি উপস্থিত হয়ে তাদের বক্তব্য দেন। এরা হলেন পঙ্খী বিশ্বাস, মুন্না বিশ্বাস, নিপেন বিশ্বাস, সাধন বিশ্বাস ও অঞ্জলি বিশ্বাস। তারা স্বীকার করেছেন, ওই জমির মালিক তারা কেউই না। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে তারা যুগ যুগ ধরে সেখানে বাস করে আসছেন। জমির মালিক দাবিদার সাজ্জাদেও সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধও নেই। তাদের মোড়ল বাবুল পাহাড়িয়ার মধ্যস্থতায় তারা সাজ্জাদের কাছ থেকে টাকা পেয়েছেন। তবে বসবাসের মতো তাদের নিজেদের কোনো জায়গা না থাকায় এখানেই থাকতে চান।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি গণেশ মার্ডির ভাষ্য ছিল, যেহেতু তারা এখানে অনেক দিন ধরে বাসবাস করে আসছেন, তাই তাদের স্থায়ী একটা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঝামেলা এড়ানো যায়। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সহযোগিতাও চান তিনি। এছাড়া একজন সাংবাদিক ও আইনজীবীও এসিল্যান্ডের তদন্তে তাদের মতামত দিয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জমির দলিল, খতিয়ান, রেকর্ড ও নামজারি যাচাই করে দেখা গেছে জমিটি ১৯৯৪-৯৫ সালে বৈধভাবে ক্রয় করেছিলেন সাজ্জাদ আলী। তার নামে জমির সব আইনি নথি বিদ্যমান থাকায় তিনি জমির প্রকৃত মালিক। এমনকি তিনি আদিবাসীদের সেখান থেকে সরে যেতে কোনো ধরনের বল প্রয়োগ করেননি। এমনকী কোনো পক্ষই এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। সেইসঙ্গে তাদের মানবিক কারণে প্রতিজনকে দুই লাখ করে মোট ৩০ লাখ টাকার একটি আপসনামা চুক্তিও হয়। এরপর সেখান থেকে তারা সাড়ে ২৭ লাখ টাকা গ্রহণও করেছেন। পাশাপাশি উৎসব করে উচ্ছেদ নয়, বরং পাহাড়িয়া ও মুসলমান প্রতিবেশীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তারা এই পিকনিকের আয়োজন করতে বলেন। তদন্ত কমিটির কাছে তারা এটি স্বীকারও করেছেন।

এতে আরও বলা হয়, যেহেতু পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং বেশিরভাগই বিভিন্ন স্থানে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের ওই স্থান থেকে উচ্ছেদ করা হলে ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় তা দেশের ভাবমূর্তিকে সংকটে ফেলতে পারে।

তাদের জোর করে উচ্ছেদ, বল প্রয়োগ ও ভয়ভীতি দেখানোরও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার পরামর্শ এবং উপযুক্ত আদালত/ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া পাহাড়িয়া সম্প্রদায়কে ওই স্থান থেকে উচ্ছেদ না করতে মালিকানার দাবিদার সাজ্জাদকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বোয়ালিয়া থানা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন বলেন, ‘আমরা সব ধরনের কাগজপত্র পর্যালোচনা করেছি। তদন্তে নিশ্চিত হয়েছি, জমিটির মালিকানা আইনগতভাবে সাজ্জাদ আলীর।’

তিনি আরও বলেন, ‘নিজেরাও স্বীকার করেছেন সাজ্জাদ আলী তাদের থাকতে দিয়েছেন। তারা জমিতে শুধু থাকেন। সাজ্জাদ আলী ১৯৯৪ সালে তিনটি দলিলমূলে কিনে নিয়েছেন। এই তিনটি দলিল আমরা যাচাই করে সত্যতাও পেয়েছি। তবে মানবিক দিক বিবেচনায় জমির মালিককে বলেছি, আপনি তাদের নিজে নিজে উচ্ছেদ না করে আইন-আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে।’

এ বিষয়ে সাজ্জাদ আলী বলেন, “আমি বৈধভাবে জমি কিনেছি এবং বহু বছর ধরে এর দখলে আছি। পাহাড়িয়ারা আগে থেকেই সেখানে ছিলেন। আমারই নানা কাজ করেন তারা। মানবিক কারণে এতদিন উচ্ছেদ করিনি। তাদের আমি কারও কারও বাড়িও তৈরি করে দিয়েছি। তারা এখন চলে যাবেন। ঠিক এইসময় একটি পক্ষ এটিকে ‘সংখ্যালঘু ইস্যু’ বানানোর অপচেষ্টা করছে। তারা আমাকে ভূমিদস্যু সাজিয়েছেন। আমি প্রশাসনের কাছে আমার জমির কাগজপত্র জমা দিয়েছি। তারাও আমাকে মিথ্যে প্রমাণ করতে পারেননি। কিন্তু তৃতীয়পক্ষ হীন উদ্দেশ্যে পানি ঘোলা করছেন।”

এসআর/এমএস

Read Entire Article