চীন সফরের বিষয়বস্তু তুলে ধরতে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে কোটা আন্দোলন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,‘মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? তাদের নাতিপুতিরা চাকরি পাবেনা,তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?এটা আমার দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন'।এই বক্তব্যকে উল্টো ব্যাখ্যা দিয়ে কোটা আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীরা কোটা বিরোধী ব্যানারে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার,রাজাকার স্লোগান দিয়ে মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে আসে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট।এখানে তো তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেননি।ভুলে গেলে চলবে না,তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন,জাতির পিতার কন্যা।তাই আপনার-আমার থেকে এদেশের প্রতি,মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর আবেগ অনেক বেশি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।জাতির পিতার আহ্বানে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে প্রিয় বাংলাদেশ।সেখারে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও একজন রাজাকারের সন্তানের যদি সমান যোগ্যতা থাকে,তাহলে নিঃসন্দেহে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অগ্রাধিকার পাবে।এটা একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি করুণা নয়,এটা তাদের প্রাপ্য সম্মান।কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে হাতিয়ার করে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে তাদেরকে স্বঘোষিত রাজাকার হতে বাধ্য করেছে।স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে যে সুযোগটি খুঁজেছিল,এক্ষেত্রে তারা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পেরেছে।তরুণ প্রজন্মকে সাময়িক সময় হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছে।
বাংলাদেশে রাজাকার একটি ঘৃণিত শব্দ।একাত্তর সালে তাদের কর্মকান্ডের জন্য রাজাকাররা আইনের চোখেও অপরাধী।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করতে,বাঙালি মুক্তিকামী মানুষকে নিধন করতে একাত্তর সালের মে মাসে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়।খুলনার খানজাহান আলী রোড়ের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থীকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী প্রথম গঠন করা হয়।পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙালি দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ও যুদ্ধের ডাক দিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়।বাহিনীর আমির হন তৎকালীন ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী।মুজাহিদ ও কাদের মোল্লার নেতৃত্বে আলবদর ও আলশামস গঠন হয়।জুনে জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে এবং সেপ্টেম্বরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক অধ্যাদেশ বলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়।রাজাকার বাহিনী জনমনে আতঙ্ক তৈরি করতে হত্যা,গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো পাষবিক নির্যাতন করেছে।পাকিস্তানী বাহিনীর পতনের মধ্যে দিয়ে রাজাকার বাহিনীরও বিলুপ্ত ঘটে।তখন কয়েক জন চিহ্নিত রাজাকার গ্রেফতার হলেও অধিকাংশই সমাজের মূলস্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিল রাজাকাররা।বাঙালিদের নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। রাজাকার হয়ে উঠেছিল নৃশংসতার সমার্থক শব্দ।রাজাকারদের অত্যাচারে বাংলাদেশ শ্মশান ভূমিতে পরিনত হয়েছিল।এদের সহযোগী ছিল আলবদর,আলশামস। তরুণ প্রজন্মকে জানতে হবে,একাত্তরে রাজাকারদের ভূমিকা কতটা নৃশংস ছিল।
কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের স্লোগান ছিল ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার,রাজাকার।’,‘চাইতে গেলাম অধিকার,হয়ে গেলাম রাজাকার’,‘মুক্তির যুদ্ধের চেতনা,দেশটা কারো বাপের না’,‘লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে’,‘জেগেছে রে জেগেছে,ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘দালালি না রাজপথ,রাজপথ রাজপথ’ এই ধরনের স্লোগান দেন।এধরনের স্লোগান প্রমান করে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিরোধী অপশক্তি ঢুকে গেছে।কোটা আন্দোলনের আড়ালে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংগঠন ও মানুষ গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদে মূখর হয়ে উঠে।‘তুমি কে – আমি কে?/বাঙালি,বাঙালি।তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।’‘একাত্তের হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার।’,‘তোরা যারা রাজাকার,তোদের নাই কোনো অধিকার’,‘তোরা যারা রাজাকার,এই মুহুর্তে বাংলা ছাড়।’এই ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষেরা বিবৃতি,বক্তব্য,মানববন্ধন ও সমাবেশ করছে ।
২০১৮ সালে কোটা বিরোধী আন্দোলনের পর সরকার সকল কোটা বাতিল করেছে।তাতে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই নয়,নারী ও অনগ্রসর এলাকা বা সম্প্রদায়ের অনেকে অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।পরে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন সন্তান হাইকোর্টের শরনাপন্ন হয়েছিলেন।গত ৫ জুন আদালত রায়ে বলেন,কোটা থাকবে।তবে সংস্কার করতে পারবে সরকার,বাড়াতে ও কমাতে পারবে।অর্থাৎ হাইকোর্টের আদেশ হলো কোটা থাকতে হবে।সরকার উচ্চ আদালতে আপীল করেছে।মহামান্য আপীল বি়ভাগ ৭ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করেছে।
কোটা আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একটি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী প্লাটফরম তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এইচআর/জেআইএম