‘রায় পড়বো তারপর মন্তব্য, এখনো কাউকে কপি দিচ্ছি না’
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। মামলার অপর আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ ও প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বুধবার (২৬ নভেম্বর) সাংবাদিকদের এমন তথ্য নিশ্চিত করেন। আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা রায়ের কপি হাতে পেয়েছি, এখন আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ এদিকে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর প্রসিকিউটর মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পেয়েছি, পড়ার পর মন্তব্য করবো। এখন রায়ের কপি কাউকে সরবরাহ করা হবে না।’ ২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল গত ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। রায়ে শেখ হাসিনা ও কামালকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। মামলার অপর আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ ও প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বুধবার (২৬ নভেম্বর) সাংবাদিকদের এমন তথ্য নিশ্চিত করেন।
আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা রায়ের কপি হাতে পেয়েছি, এখন আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এদিকে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর প্রসিকিউটর মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পেয়েছি, পড়ার পর মন্তব্য করবো। এখন রায়ের কপি কাউকে সরবরাহ করা হবে না।’
২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল গত ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
রায়ে শেখ হাসিনা ও কামালকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। তবে রাজসাক্ষী হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তথ্য দিয়ে আদালতকে সহযোগিতা করায় তাদের সহযোগী ও সাবেক আইজিপি মামুনকে পাঁচ বছরের লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী মানবতাবিরোধী অপরাধে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড পেলেন। এটি জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত প্রথম রায়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ওই বছরের ১৪ আগস্ট গণহত্যার অভিযোগের পরে তদন্ত শুরু হয়। মামলাটি তদন্ত করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সদস্য মো. আলমগীর। গত ১৭ জুলাই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়।
প্রসিকিউশনের পক্ষে ৫৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। হাসিনা ও কামাল পলাতক থাকায় তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার হয়। রায়ে আদালত বলেছেন, হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে।
তবে, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগকে আদালত একসঙ্গে গ্রহণ করেছে। এই অভিযোগে হাসিনা ও কামালের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযোগকে একীভূত করে এই অভিযোগে হাসিনা ও কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মামুনের ব্যাপারে আদালত বলেছেন, তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলার ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে আদালতকে সাধ্যমত সহযোগিতা করেছেন। তার তথ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে। তবে তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের শামিল হলেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করায় আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
প্রথম অপরাধ
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে প্রথম অপরাধ সংঘটিত হয়। সেখানে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কামাল, মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্ররোচণায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ব্যাপক ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। এর অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততার পাশাপাশি অপরাধ প্রতিরোধে ব্যর্থ হন। এই অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি না দিয়ে ষড়যন্ত্র করেন। এই অপরাধ সংঘটনের স্থান গণভবন থেকে সারা বাংলাদেশ বিস্তৃত এবং গত বছরের ১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তা ঘটে।
এই অভিযোগের বিবরণে ২০২৪ সালের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আদালনকে যৌক্তিক বলে উল্লেখ করা হয়। গণভবনে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন। সেখানে তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক কোটা সংস্কারের দাবিকে অবজ্ঞাসূচক ও হিংসাত্মক বক্তব্য দেন। বিশেষত, আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে গালি দেন। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে নিরীহ-নিরস্ত্র আন্দোলনরত ছাত্রজনতাকে ‘রাজাকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের নির্মূলের প্ররোচনা দেন।
শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে আসামি কামাল ও মামুন অধীনস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং তাদের এ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হাসিনার ওই বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হন। তারা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালান।
হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কামাল ও মামুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে দেড় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়, ২৫ সহস্রাধিক মানুষকে গুরুতর জখম করা হয়। অনেকে স্থায়ীভাবে অঙ্গহানি ও অন্ধত্ববরণসহ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়।
হাসিনার বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা নিতে বাধা দেওয়া হয়। এমনকি নিহতদের মৃত্যু সনদে মৃত্যুর সঠিক কারণ লিখতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ভিন্ন কারণ লিখতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয়, নিহতদের জানাজা এবং কবরস্থ করতেও বাধা দেওয়া হয়। নিহতদের স্বজনদের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর না করে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গণকবরে দাফন করা, লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পদে এবং আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য, ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অধীনস্ত ও রাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনী, কামাল এবং মামুন তাদের অধীনস্থ বাহিনীর মাধ্যমে দেশব্যাপী আন্দোলনরত ছাত্র জনতার ওপর আক্রমণ করে।
দ্বিতীয় অপরাধ
হাসিনা ছাত্রজনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ অনুসারে কামাল ও মামুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দেন ও কার্যকর করেন। এর মাধ্যমে অপরাধের নির্দেশ, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, যা তাদের জ্ঞাতসারে হয়েছে। এই অপরাধের ঘটনাস্থল গণভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন এবং সারা বাংলাদেশ। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন থেকে ও ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে।
অভিযোগের বিবরণে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালের মধ্যে ফোনালাপ হয়। তাতে দেখা যায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের চেয়ারে বসে হাসিনা আবারও রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তাদের ফাঁসি দেওয়া ও গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন।
একই বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনা এবং তার ফুফাত ভাইয়ের ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের মধ্যে ফোনালাপ হয়। তাতে দেখা যায়, আন্দোলনরত ছাত্রজনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে নির্মূলের নির্দেশ দেন। তিনি ড্রোনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করে আটক এবং তাদের দমাতে হেলিকপ্টার ব্যবহারের নির্দেশ দেন। পরে আন্দোলনকারীদের আটক, নির্যাতন এবং হেলিকপ্টার দিয়ে নির্বিচারে গুলি করা হয়। এতে নারী ও শিশুসহ দেড় সহস্রাধিক মানুষ হত্যা এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। হাসিনার পরিকল্পনা ও নির্দেশ কামাল ও মামুন অধীনস্থদের দিয়ে বাস্তবায়ন করেন।
হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা কামাল ও মামুন তা পর্যবেক্ষণ করতেন। আন্দোলন চলাকালে ২৭ জুলাই যাত্রাবাড়ী থানার সামনে, পুলিশের ওয়ারী জোনের ডিসি মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইনের মোবাইলে ধারণ করা—আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যার ভিডিও কামাল ও মামুনকে প্রদর্শন করেন। ডিসি ইকবাল বলেন, ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায়, বাকিডি যায় না স্যার, এইডাই আতঙ্ক। এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’ এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং নির্দেশনায় দেশব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
হাসিনার ফোনালাপ থেকে আরও জানা যায়, তার পরিকল্পনায় দলীয় ক্যাডার বাহিনী সেতু ভবন, বিটিভি ভবন, মেট্রোরেল স্টেশনসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনা অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পুড়িয়ে দেয়। পরে ছাত্র-জনতার ওপরে দায় চাপানো হয়।
তৃতীয় অপরাধ
হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহারে হত্যার নির্দেশে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো হয়। এর অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে স্বল্প দূরত্ব থেকে নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদকে একাধিক গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। যার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়।
অভিযোগের বিবরণে বলা হয়, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের দাবি প্রসঙ্গে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করেন। তিনি মন্তব্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূলের প্ররোচনা দেন। তার উসকানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। শুধু তাই নয়, তার বক্তব্যে বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো হয়। আর কামাল ও মামুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার নির্দেশ দেন। কামাল ও মামুন তাদের নির্দেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর অমানবিক আচরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ করে।
এরই অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে স্বল্প দূরত্বে পুলিশের এএসআই মো. আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় গুলি করে হত্যা করেন।
আবু সাঈদের মৃতদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ গোপন করা হয়। ‘গুলিতে তার মৃত্যু হয়েছে’, বিষয়টি উল্লেখ না করে ‘মাথায় আঘাতজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে’ মর্মে সুরতহাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে গুলিতে নিহত হওয়ার তথ্য গোপন করতে পুলিশ এবং আওয়ামী সমর্থিত ডাক্তারদের চাপে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারকে চার বার রিপোর্ট পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়। দায়ী ব্যক্তিদের আড়াল করতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আবু সাঈদের সহযোগী আন্দোলনকারীদের আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়। এর মাধ্যমে আসামিরা অমানবিক আচরণ করেছে, যা ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে মানবতাবিরোধী অপরাধ।
চতুর্থ অপরাধ
শেখ হাসিনার নির্দেশে আসামি কামাল ও মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনায় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা হয়। এর অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে নিরস্ত্র ছয়জন ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে।
অভিযোগের বিবরণে বলা হয়, ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার মন্তব্য আন্দোলনকারীদের দমনে প্ররোচনা দেয়। এতে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। পরবর্তী সময়ে ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের নেতারা হাসিনার ওই উসকানিমূলক বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হন। এরপর পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। কামাল ও মামুন বিষয়টি সার্বক্ষণিক সরেজমিনে পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করতেন। শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মাকসুদ কামালের ফোনালাপ এবং শেখ হাসিনা ও ব্যারিস্টার তাপসের ফোনালাপে ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে আক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়।
৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিকে দমনের জন্য হাসিনা, কামাল ও মামুনের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে গুলির নির্দেশনা বাস্তবায়নে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশ মুখের মতো চানখাঁরপুল ও তার আশপাশে এলাকায় প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। পরে কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ইমন, মো. নাসিরুল ইসলামের সুনির্দিষ্টভাবে গুলিতে শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহাদী হাসান জুনায়েদ ওরফে মোস্তাকিন, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মোহাম্মদ ইসমামুল হক এবং মানিক মিয়া ওরফে শাহারিকসহ মোট ছয়জন নিহত হয়।
ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল ও পুলিশ পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেনের যোগসাজশ ও নির্দেশে এই হত্যা সংঘটিত হয়, যা ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে মানবতাবিরোধী অপরাধ।
পঞ্চম অপরাধ
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশে ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছয় ছাত্র-জনতাকে গুলি ছুড়ে হত্যা করে। তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃতদেহ পোড়ানো হয় এবং একজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
অভিযোগের বিবরণে বলা হয়, হাসিনার উসকানি, নির্দেশ ও প্ররোচনায় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দমনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও তৎকালীন ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে পুলিশ ও আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আশুলিয়া থানা এলাকায় ছাত্রজনতাকে গুলি ছুড়ে হত্যা করতে থাকে। আর হাসিনার পতনে আশুলিয়া থানার আশপাশে বিজয় উল্লাসরত সাধারণ ছাত্রজনতাকে লক্ষ করে বেপরোয়া গুলি করে পুলিশ ও আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এতে পাঁচজন নিহত এবং একজন আহত হয়। পরে নিহত সাজ্জাদ হোসেন সজল, আস-সাবুর, তানজিল মাহমুদ সুজয়, বায়েজীদ বোস্তামী, আবুল হোসেনের মৃতদেহ এবং একজনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মৃত ও জীবিত অবস্থায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে অমানবিক আচরণ করা ট্রাইব্যুনাল আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ।
এফএইচ/এমএমএআর/এমএস
What's Your Reaction?