‘লাকী সাউন্ড এর পক্ষ থেকে আমি লনিক আপনাদের সকলকে জানাই অনেক অনেক শুভেচ্ছা।’ ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর বিয়ে কিংবা করপোরেট হাউজগুলোর বিশেষ দিনের আয়োজনে প্রায়ই কালচারাল পার্ট শুরু হয় এই বাক্যটি দিয়ে। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে একজন স্বপ্নবাজ তরুণ মো. সিদ্দিকী লনিকের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে লাকী সাউন্ড।
২০০৫ সাল থেকে ফ্রীল্যান্স সিঙ্গার ও গীটার প্লেয়ার হিসেবে কাজ শুরু করলেও লাকী সাউন্ড এর কর্ণধার মো. সিদ্দিকী লনিক ২০১১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত উচ্চ শিক্ষা এবং চাকরির জন্য মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি থেকে সাময়িক বিরতি নেন। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ থেকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিবিএ ও এমবিএ তে টপ ক্লাস রেজাল্টের পর অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কিছু কোম্পানিতে Global Sales & Marketing এবং মানব সম্পদ বিভাগে চাকরি করেন যার মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপ অন্যতম। একজন সফল HR Brand Promoter এবং Recruiter হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন প্রতিষ্ঠানের অর্পিত দায়িত্ব।
মিউজিকের বিরতির এই সময়ে তিনি ভাবতে থাকেন কি করে বাংলাদেশের লাইভ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যেহেতু নিজে ফ্রীল্যান্স মিউজিশিয়ান ছিলেন তাই মন পড়ে ছিল সেদিকেই। লাইভ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ভিন্ন কিছু উপস্থাপণ করে দেশের সাংস্কৃতিক অংগণকে বিশ্বমানের করা যায় সেটা নিয়েই ভাবছিলেন।
অবশেষে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে করপোরেট চাকরি ছেড়ে চলে আসেন হুট করেই। দীর্ঘদিনের অনুধাবন থেকে বুঝতে পারেন এই দেশে মান সম্মত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কিংবা এজেন্সির কমতি নেই। কমতি আছে মান সম্মত লজিস্টিক সাপোর্ট এর যেমন প্রফেশনাল সাউণ্ড সিস্টেম, লাইট, ট্রাস, এল ই ডি স্ক্রীণ এবং ক্যামেরার।
এছাড়াও কমতি আছে দক্ষ টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফের। তখনই চিন্তা করেন লজিস্টিক সাপোর্ট রেন্টালের ব্যাবসা। ২ টা ছোট স্পীকার এবং একটা প্রজেক্টর ভাড়া নিয়ে শুরু হয় লাকী সাউন্ড এর যাত্রা। নিজে সিঙ্গার এবং মিউজিশিয়ান হওয়ায় শিল্পীদের নিয়ে কাজ করাই হতো বেশি। প্রথম দিকে ঘরোয়া, পারিবারিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হতো বেশি। কাজ করতে করতে বুঝতে পারেন এদেশের ক্রমবর্ধমান ওয়েডিং মার্কেটে এ কাজের বেশ সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিশীলতার অভাব আছে বেশ। তখনই আর্টিস্ট ম্যানেজমেন্টের বিষয়টি মাথায় আসে।
কখনও গ্র্যান্ড পিয়ানো কখনও বা সেতার দিয়ে যন্ত্রশিল্পীদের পরিবেশনা কখনও বা নামী এবং প্রফেশনাল শিল্পীদের নিয়ে গানের, কাওয়ালী, ফোক, রবীন্দ্র, নজরুল বা উচ্চাঙ্গ সংগীতের আয়োজন। প্রয়োজন হলে কাস্টমাইজ অরক্রেস্টা নিয়ে করছেন বিশ্বমানের ‘কোয়ের’ সেট আপ।
সম্পূর্ণ নিজ উদ্দ্যোগে লাইভ কনসার্টগুলোতে প্রমোট করে চলেছেন প্রতিভাবান ইয়াং শিল্পী এবং মিউজিশিয়ানদের।
একটা প্রোগ্রাম পেলে একজন দক্ষ লাইভ মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে পরিবার বা ক্লায়েন্টদের সাথে বসে তাদের চাহিদা শুনে নিজের অভিজ্ঞতা ও স্কীলের ব্যবহার করে একটা সুন্দর উপস্থাপন তৈরি করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত অত্যন্ত সফলভাবে। এমনকি অনেক সময় বাজেট ইস্যুতে ভুগতে থাকা আয়োজনে শুধুমাত্র গীটার ও কাহনের সমন্বয়ে গানের আয়োজন করেও মানুষকে দিয়েছে বিনোদন। একটা আয়োজনে গিয়ে পেয়েছেন আরও নতুন প্রোগ্রামের অর্ডার। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন সফলভাবে।
বাংলাদেশের প্রথম অনলাইনে ফেসবুক পেজ ‘লাকী সাউন্ড’র মাধ্যমে চালু করেন অনলাইনে লজিস্টিক সেবা ও আর্টিস্ট ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস। এখন পর্যন্ত ৫০ টির মত আয়োজনের অর্ডার পেয়েছেন পেজের মাধ্যমে। যেখানে কাস্টমার বা লাকী সাউন্ড এর প্রতিনিধি কেউ কাউকে সামনা সামনি দেখেনি। অনলাইন কমিঊনিকেশন দিয়েই নির্দিষ্ট দিনে প্রোগ্রাম হয়েছে শুধুমাত্র আস্থার উপর ভিত্তি করে। এমনকি অনেকেই প্রবাসে থেকেই তার পরিবারের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করেন লাকী সাউন্ড এর অনলাইন পেজের মাধ্যমে।
প্রথমত ঢাকার ভিতর শুরু করলেও পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গেছেন মানুষের ডাকে।
দেশের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এবং লজিস্টিক সেবার নানা ফাক ফোকর, নানা ধোকাবাজি ও মধ্যসত্তভোগীদের বিষয়ে সাবধান করতে সোস্যাল এওয়ারনেস হিসেবে বিশ্বের পেশাজীবিদের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম ‘লিন্কড ইন’ এ প্রতিনিয়ত লেখা লেখি করে যাচ্ছেন। এতে উপকৃত হচ্ছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। সাউণ্ড, লাইট, এলইডি টেকনিশিয়ানদের নিয়ে ফেসবুকে করেছেন সাউণ্ড অপারেটর গ্রুপ। সেখানেও তাদের স্কীল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে নানা টিপস দিয়ে যাচ্ছেন।
বাধা এসেছে অনেক। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ঊঠে এসে দামি লজিস্টিক আইটেম কিনতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন অনেক। চিকিৎসক স্ত্রী পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন। নিজের নামে ব্যাংক লোন নিয়ে এগিয়ে আসেন সঙ্গীর স্বপ্ন পুরণে। বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়িও ছিলেন পাশে।
প্রথমে শুধু পারিবারিক, বিয়ে কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রোগ্রাম পেলেও গত ২ বছর ধরে করপোরেট হাউজ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাকী সাউন্ড একটা জনপ্রিয় নাম। বিশেষ করে মিডরেঞ্জ কোম্পানির সেলস কনফারেন্স, পিকনিক, ডে আউট বা গার্মেন্টসগুলোতে লাকী সাউন্ড এখন বিনোদনের খোরাক মেটানোর শীর্ষে।
লাকী সাউন্ড শুধু মাত্র গানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিভিন্ন ধর্মীয় আয়োজনেও বদলে দিয়েছে চিরাচারিত রুপ। সব ধর্মের মানুষ আসছে তাদের বিশেষ দিনের আয়োজনে ভিন্ন কিছু করতে লাকী সাউন্ড এর মাধ্যমে। এই কাজেও সফল লাকী সাউন্ড।
এত বছরেও নিজের একটি অফিস সেট করেননি পাগলাটে এই তরুণ উদ্দ্যোক্তা। এখনও নিজের বাড়ির একটি গ্যারেজ থেকে পরিচালনা করেন সব কিছু। বলেন একটা মোবাইল, ল্যাপটপ, ডাইরি এবং কলমই তার অফিস।
সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ৪-৫ জন কিশোর নিয়েই টিম বানানো শুরু থেকে (কারোও বাবা নাই, কারো মা বা কারো পরিবার নেই) নিজের সাথেই রাখেন তাদের, খান একই খাবার। তাদের সবাই এখন দক্ষ টেকনিশিয়ান। ইভেন্ট লজিস্টিক সেক্টরে কাজ করা ছেলেদের অধিকার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন অনেক দিন ধরেই।
নিজেদের লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়াতে দিন দিন বিশ্বমানের লাইট, সাউন্ড, এল ই ডি স্ক্রীণ যোগ করে যাচ্ছে নিজেদের বহরে।