ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের শ্মশানঘাট মাঠে শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে চরমপন্থি দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক শীর্ষ নেতা, একাধিক হত্যা, চাঁদাবাজি ও ডাকাতি মামলার আসামি হানিফসহ (৫০) তিনজন নিহত হন।
এর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় জমি নিয়ে বিরোধে এক ব্যক্তি প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে ভয় দেখান। পিস্তলের গুলিতে একজন আহত হন বলেও দাবি করা হয়। ইতোমধ্যে ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
একইদিন সকালে রাজধানীর উত্তরায় চলন্ত বাসে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাটিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুক পোস্টে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন ভুক্তভোগী এক নারী।
ওপরের তিনটি ঘটনা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দুর্বৃত্তদের তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব অপরাধে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ বক্সসহ বিভিন্ন ইউনিট-স্থাপনা থেকে লুট করা আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগ্নেয়াস্ত্র বেশি দিন বেহাত থাকলে তা সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, উগ্র গোষ্ঠী, সুযোগসন্ধানীসহ অপরাধ জগতে চলে যেতে পারে। বিপুল সংখ্যক অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা না হওয়ায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে, ছোটখাটো ঘটনা কিংবা হুমকি-ধামকিতেও অস্ত্র প্রদর্শন এমনকি গুলির ঘটনাও ঘটছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জনজীবনের নিরাপত্তা।
‘স্বৈরাচার এবং তাদের দোসররা বিভিন্ন জায়গায় একত্রিত হচ্ছে এবং কর্মসূচি দিচ্ছে, তারা দেশকে একটা অরাজকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।’ -প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ
লুট হওয়া ১৩৮৪ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ বক্সসহ বিভিন্ন ইউনিট-স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের ১১ ধরনের অস্ত্র ও আট ধরনের গোলাবারুদ লুট হয়। লুট হওয়া অস্ত্রের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৭৫০টি, গোলাবারুদের সংখ্যা ছয় লাখ ৫১ হাজার ৯৬৯টি।
লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ ফেরত দিতে দেশবাসীর কাছে অনুরোধ জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন হাজার ৮৮০টি অস্ত্র ও দুই লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৩ রাউন্ড গোলাবারুদ্ধ উদ্ধার হয়। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর থেকে দেশজুড়ে যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হয়। সেই অভিযান এখনও চলমান।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে ‘বিশেষ অভিযান’ শুরু হয়েছে। এ অভিযানে আসামি গ্রেফতারের পাশাপাশি অস্ত্রও উদ্ধার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে গত ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার হাজার ৩৬৬টি উদ্ধার হয়েছে। এখনো উদ্ধার হয়নি এক হাজার ৩৮৪টি আগ্নেয়াস্ত্র ও দুই লাখ ৬০ হাজার ৫৩১টি গোলাবারুদ।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ সংক্রান্ত অধিবেশন শেষে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ সাংবাদিকদের জানান, জেলা প্রশাসক হিসেবে আগামী দিনে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সে বিষয়ে বলেছি। যেমন- আমি বলেছি প্রায় ১ হাজার ৪০০ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি, যেগুলো ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে লুট হয়েছিল। আড়াই লাখ গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি। সেগুলো তাদের জেলায় কোনো না কোনো জায়গায় আছে। সেগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে পড়তে পারে এবং তারা ব্যবহার করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আমি উল্লেখ করেছি স্বৈরাচার এবং তাদের দোসররা বিভিন্ন জায়গায় একত্রিত হচ্ছে এবং কর্মসূচি দিচ্ছে, তারা দেশকে একটা অরাজকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।’
আওয়ামী লীগের সময় ১৬ বছরে যাদের রাজনৈতিকভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই অস্ত্র জমা দেননি। তবে লাইসেন্স করা অধিকাংশ অস্ত্রই পুলিশ জব্দ করেছে। কিন্তু লুট হওয়া অনেক অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, যেগুলো জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে। পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র বাংলাদেশে ঢোকানোর এবং দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।- স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া
আওয়ামী লীগ নেতাদের সব অস্ত্র জমা পড়েনি
২০০৯ সাল থেকে গত ১৬ বছর রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের লাইসেন্স দেওয়া অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। তাদের মধ্যে অনেকেই অতীতে অস্ত্রবাজি করে বিতর্কিত হয়েছেন। অনেকেই লাইসেন্স করা অস্ত্র এখনও জমা দেননি। বিপুল সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র-গুলি ‘লাগামহীন’ থাকায় বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। আইন ও সালিশ (আসক) কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে সারা দেশে রাজনৈতিক কোন্দলে নিহত হয়েছেন ৫৬ জন, আহত হয়েছেন দুই হাজার ৪১৯ জন।
পুলিশ সূত্র মতে, দেশে লাইসেন্স থাকা বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি। এর মধ্যে ব্যক্তির হাতে ৪৫ হাজার ২২৬টি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঁচ হাজার ৮৪টি অস্ত্র আছে। ব্যক্তিগত অস্ত্রের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে আছে সাত হাজার ৫৪৯টি। অনেক বিতর্কিত রাজনীতিকের হাতে বৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রও রয়েছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সারাদেশে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ওই নেতাকর্মীদের এখনো চিহ্নিত করে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, আওয়ামী লীগের সময় ১৬ বছরে যাদের রাজনৈতিকভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই অস্ত্র জমা দেননি। তবে লাইসেন্স করা অধিকাংশ অস্ত্রই পুলিশ জব্দ করেছে। কিন্তু লুট হওয়া অনেক অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, যেগুলো জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে। পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র বাংলাদেশে ঢোকানোর এবং দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এই বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকার জানতে পেরেছে।
আসিফ মাহমুদ বলেন, অস্ত্র উদ্ধারে যৌথবাহিনীর যে অভিযান হয়েছিল, সেটা ইফেক্টিভাবে যাতে আবার পরিচালনা করা যায় এবং জনগণের জন্য হুমকিস্বরূপ যে অস্ত্রগুলো এখনো বাইরে আছে, সেগুলো উদ্ধারে আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দ্রুত নির্দেশনা দেব। আপনারা এর দৃশ্যমান সাফল্য দেখতে পাবেন।
অস্ত্র ঠেকিয়ে কয়েকটি অপরাধের ঘটনা
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন কালারপুল এলাকায় প্রকাশ্যে ভারী অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় একদল দুর্বৃত্ত। এক ব্যবসায়ীর কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে অস্ত্র নিয়ে সেখানে হামলা চালায়। সাজ্জাত বাহিনীর সন্ত্রাসকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় চট্টগ্রামে দিনদুপুরে আফতাব উদ্দিন তাহসীন নামের এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ পায় পুলিশ।
১৬ অক্টোবর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের গুলিতে মো. শাহনেওয়াজ (৩৮) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। পরদিন ১৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার দিকে মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ কাঁচাবাজার মার্কেট দখল কেন্দ্র করে গুলির ঘটনা ঘটে। মার্কেটের সভাপতি আবুল হোসেন (৫০) ও তার ছোট ভাই মাহবুবকে (৪২) গুলি করে দুর্বৃত্তরা।
অস্ত্র দেখিয়ে নারীকে ধর্ষণ
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় গত ২৪ জানুয়ারি ভোরে ভুক্তভোগী নারীর স্বামী ফজরের নামাজ পড়াতে মসজিদে যান। এই সুযোগে বাড়িতে ঢোকেন হৃদয় বিশ্বাস (২৭)। এ সময় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ওই নারীকে ধর্ষণ করেন হৃদয়। পরে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে হৃদয় বিশ্বাসকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
অস্ত্রের মুখে তরুণীকে শ্লীলতাহানি ও বিয়ের চেষ্টা
ফরিদপুরের লক্ষ্মীপুর এলাকায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে এক তরুণীর বাড়ি গিয়ে বিদেশি পিস্তল দেখিয়ে তাকে বিয়ে করতে বলেন মেহেদী হাসান দিদার (৪২) নামের একজন। এ সময় শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন মেহেদী। ভুক্তভোগী তরুণী কৌশলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানান। এরপর কোতোয়ালি থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অস্ত্রসহ মেহেদীকে গ্রেফতার করে।
এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফাহিম ফয়সাল তরফদার জানান, তরুণীর বাসায় গিয়ে অস্ত্রের মুখে তাকে জিম্মি করে উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে মেয়েটি অভিযোগ করেন। ঘটনাস্থল থেকে একাধিক মামলার আসামি মেহেদী হাসান দিদারকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় ৯টি মামলা আছে।
যৌথবাহিনীর সদস্যদের গাড়িতেও হামলা
গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় অভিযানে থাকা যৌথবাহিনীর সদস্যদের গাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় আত্মরক্ষার অংশ হিসেবে ২৪ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে যৌথবাহিনী। পরে ধাওয়া দিয়ে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় চারটি আগ্নেয়াস্ত্র, ছয়টি ধারালো অস্ত্র, আটটি গুলি ও ২০টি ককটেল।
জুয়েলার্সে ডাকাতির সময় গুলি
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় প্রীতি জুয়েলার্সে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাত দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ২৫ ভরি সোনা লুট করে নিয়ে যায়। লুট করা সোনার বাজার মূল্য ৩৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। সোনা লুট করে ডাকাত দল গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় ডাকাতদের গুলিতে বুকের ডান পাশে গুলিবিদ্ধ হয় দোকানের স্বত্বাধিকারী। তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অন্তঃসত্ত্বা নারী গুলিবিদ্ধ, পরে সন্তানের জন্ম
মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন নিয়ে দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষের গুলিতে দুজন নিহত হওয়ার জেরে নতুন করে হামলায় পিংকি আক্তার (২৩) নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পর তিনি সন্তান প্রসব করেন। ৩১ জানুয়ারি সকালে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নের কালীরচর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
অস্ত্রোপচারের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক রুনা আক্তার দোলা বলেন, কোমরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে রোগীর শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। বাচ্চা পেটে নড়াচড়াও করছিল না। তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে অপারেশন করা হয়। এখন মা ও বাচ্চা সুস্থ আছেন।
চাহিদামতো চাঁদা না পেয়ে গুলি
গত ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডি-৭ এ মোটরসাইকেলে আসা অস্ত্রধারীরা একটি নির্মাণাধীন ভবনের সামনে পিস্তলের ১০টি গুলি ছোড়ে। একটি ভবনের ফটকে পেট্রল ঢেলেআগুন জ্বালিয়ে দেয়, ভেঙে ফেলা হয় সিসি ক্যামেরা। নির্মাণাধীন ভবনগুলো থেকে চাহিদামতো চাঁদা না পাওয়ায় গুলি ছুড়ে হুমকি দিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।
এ ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় মামলা হয়। পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করে। তবে কোনো অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
হাজারীবাগ থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করতে দেখা গেছে, তা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না সেগুলো লুট হওয়া অস্ত্র কি না। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
মহাসড়কে আতঙ্কে যানবাহনচালক ও যাত্রীরা
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ইউনিক রোড রয়েলসের ‘আমরি ট্রাভেলসের’ একটি বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলামকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় একটি মামলা হয়।
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ৪ সেপ্টেম্বর যৌথবাহিনী অভিযান শুরু করে। অভিযানে পাঁচ হাজার ৭৫০টি লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে চার হাজার ৩৬৬টি। এখনো উদ্ধার হয়নি এক হাজার ৩৮৪টি অস্ত্র। লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে যৌথবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি শুরু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্টেও অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে।- পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর
অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা
বগুড়া সদর থানা থেকে গত ৫ আগস্ট লুট হওয়া দুটি অস্ত্র একটি ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয় গত ২৬ জানুয়ারি।
সদর থানার ওসি এস এম মঈনুদ্দিন বলেন, ডোবা থেকে জমিতে সেচের জন্য পানি নিতে গেলে একজন কৃষক কাদামাটির মধ্যে অস্ত্র দুটি দেখতে পান। পরে থানায় খবর দিলে পুলিশ অস্ত্র দুটি হেফাজতে নেয়। উদ্ধার হওয়া অস্ত্র দুটির মধ্যে একটি এলএমজি ও একটি চায়নিজ রাইফেল।
গত বছরের ৫ নভেম্বর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের লাইসেন্স করা পিস্তল রাজধানীর ফার্মগেটসংলগ্ন মণিপুরি পাড়া এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
তেজগাঁও থানা পুলিশ জানায়, মণিপুরি পাড়ার ৬ নম্বর ফটকের ১৩২ ও ১৩৯ বাড়ির মাঝখানের পাকা রাস্তার ওপর বালুর বস্তার আড়ালে একটি ব্রিফকেসের ভেতর থেকে পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়। প্লাস্টিকের কেসে থাকা এই পিস্তলের ২৫টি গুলিও জব্দ করা হয়।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলীর হাজিক্যাম্প এলাকায় চেকপোস্টে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছিলেন পুলিশ সদস্যরা। দ্রুতগতির একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা দেখে সন্দেহ হয় তাদের। পরে সেটি দাঁড় করান তারা। সেখানে তল্লাশি চালিয়ে বাজারের ব্যাগে পাওয়া যায় দুটি দেশীয় অস্ত্র। এ সময় বেলাল হোসেন (৩৫) নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর জাগো নিউজকে বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ৪ সেপ্টেম্বর যৌথবাহিনী অভিযান শুরু করে। অভিযানে পাঁচ হাজার ৭৫০টি লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে চার হাজার ৩৬৬টি। এখনো উদ্ধার হয়নি এক হাজার ৩৮৪টি অস্ত্র। লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে যৌথবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি শুরু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্টেও অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে।
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাবেন যারা
ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী যেসব ব্যক্তিরা আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স পাবেন-
১. উপদেষ্টা, ২. ক্যাডার সার্ভিসের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা, ৩. মৃত্যুজনিত/বার্ধক্যজনিত কারণে ওয়ারিশ বরাবরে হস্তান্তর, ৪. ব্যাংক/অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, ৫. ব্যক্তিপর্যায়ে তিন লাখ টাকা আয়কর প্রদানকারী ব্যক্তি।
১২ বোর বন্দুক, ২২ বোর রাইফেল লাইসেন্স জেলা প্রশাসক স্বয়ং ইস্যু করবেন। পিস্তল ও রিভলবার লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অনুকূলে পুলিশী তদন্ত প্রতিবেদন এবং আয়কর যাচাই সাপেক্ষে ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের অনুকূলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে লাইসেন্স ইস্যু করবেন।
পলক-শফিকুলের চারটি আগ্নেয়াস্ত্র এখনো জমা হয়নি
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া সময় (৩ সেপ্টেম্বর) পার হলেও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও নাটোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল অস্ত্র জমা দেননি। তাদের নামে লাইসেন্স করা চারটি আগ্নেয়াস্ত্র আছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পলক গ্রেফতার হয়ে কারাগারে, শিমুল আত্মগোপনে।
নাটোরের পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নাটোরের সাবেক দুই সংসদ সদস্য বা তাদের পক্ষে কেউ তাদের নামে লাইসেন্স করা শটগান ও পিস্তল থানায় জমা দেননি। ফলে এই দুজনের হেফাজতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র এখন অবৈধ অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হবে।
নাটোর সদর থানার ওসি মো. মাহাবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শফিকুল ইসলাম শিমুলের দুটি অস্ত্র এখনো জমা দেয়নি। পুলিশও উদ্ধার করতে পারেনি।
অপারেশন ডেভিল হান্টের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হবে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, অভিযানে যতগুলো অস্ত্র উদ্ধারের আশা করেছিলাম, ততটুকু হয়তো হচ্ছে না। তবে ধীরে ধীরে সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হবে।
যারা শীর্ষ সন্ত্রাসী তারা শুধু লুট করা অস্ত্র নিয়ে অপরাধকাণ্ড চালাচ্ছে ঠিক তেমন নয়। বাকি লুট করা অস্ত্র উদ্ধারে সরকার যদি কোনো প্রণোদনা দেয় তবে কিছু অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব। পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে এসব অস্ত্র উদ্ধারেও কাজ করতে পারে।- অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ বি এম নাজমুস সাকিব
জেল পলাতক ৭০০ আসামি এখনো ধরা পড়েনি
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে দুই হাজার ২০০ আসামি পালিয়ে যান। তাদের মধ্যে এক হাজার ৫০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনো ৭০০ আসামি পলাতক। তাদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তসহ অতিঝুঁকিপূর্ণ ৭০ জন আসামি রয়েছেন।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জানান, জেল পলাতক ৭০০ আসামিকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। তাদের মধ্যে ১০০ জন নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ বি এম নাজমুস সাকিব জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অপারেশন ডেভিল হান্ট অত্যন্ত জরুরি ছিল। অবৈধ অস্ত্র যখন সাধারণ মানুষ কিংবা সন্ত্রাসীদের হাতে থাকে তখন অন্যায়ভাবে এগুলো ব্যবহারের সম্ভাবনা থাকে। তবে যারা শীর্ষ সন্ত্রাসী তারা শুধু লুট করা অস্ত্র নিয়ে অপরাধকাণ্ড চালাচ্ছে ঠিক তেমন নয়। বাকি লুট করা অস্ত্র উদ্ধারে সরকার যদি কোনো প্রণোদনা দেয় তবে কিছু অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব। পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে এসব অস্ত্র উদ্ধারেও কাজ করতে পারে।
কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বৃদ্ধি প্রসঙ্গে এ অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রায়ই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের পুলিশ গ্রেফতার করে। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা যায় খুব তাড়াতাড়ি ছাড়া পেয়ে তারা একই কর্মকাণ্ড করে। তাদের শেল্টার দেওয়া কিছু ‘বিগ ব্রাদার’ রয়েছে। আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে এসব বিগ ব্রাদারকেও আইনের আওতায় আনা জরুরি।
টিটি/এমএমএআর/এমএস