লাল শাড়ি ও রাতের গল্প

2 hours ago 3

কবির হোসেন মিজি

রাত তখন প্রায় দুইটা। শহরের অচেনা এক রাস্তায় হাঁটছিলাম। রাতের বাতাসে কেমন একটা কাঁচা গন্ধ, রাস্তার বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে, কখনো নিভে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি ফুটপাতের ধারে বসে আছে এক যুবতী। লাল শাড়ি, চোখের নিচে গভীর ক্লান্তির ছাপ, ঠোঁটে সতেজ হাসি। অদ্ভুতভাবে সে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

আমি একটু থামলাম। তার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘এত রাতে আপনি এখানে?’
সে ঠোঁটের কোণে একটুখানি মুচকি হাসি টেনে বলল, ‘তুমিইবা এত রাতে এখানে কেন?’
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘এমনিতেই হেঁটে বেড়াই, ঘুম আসে না তাই।’
সে বলল, ‘আমারও।’

এক-দুই কথায় আমরা পাশাপাশি হেঁটে যেতে লাগলাম ফাঁকা রাস্তায়। আমাদের মাঝে কেবল মাটিতে পা ফেলার শব্দ। কিছুক্ষণ পর সে বলল, ‘তোমার নাম?’
আমি একটু থমকে বললাম, ‘সোহান। তোমার?’
সে হেসে বলল, ‘ধরা যাক, নাম নীরা।’
নীরা? নামটার মধ্যে কেমন একটা বিষণ্ণ সুর লুকানো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার হাসিটা এত সুন্দর কেন?’
সে কিছু বলল না। শুধু চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, হাত দিয়ে কপালের চুল ঠিক করল।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এক বাড়ির দেওয়ালের বন্ধ গেটের কাছে। বসে পড়লাম দুজন। আশেপাশে কেউ নেই, কেবল কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর দূরে গাড়ির শব্দ। আমি বললাম, ‘তোমার গল্প শুনবো।’
সে একটু অবাক হয়ে বলল, ‘সবাই গল্প শোনে না। শুনলেও বিশ্বাস করে না।’
আমি নরম কণ্ঠে বললাম, ‘আমি শুনতে চাই তোমার জীবনের গল্প।’
সে মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি একজন নিষিদ্ধ মানুষ। গতর বেচে খাই। সব পুরুষ শুধু আমার শরীরের কাঁচা মাংস খেতে চায়। কেউ মন বোঝে না, আমাদের ভেতরের গল্পটা কেউ শুনতে চায় না।’
কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা পানি নেমে এলো।

তার মুখে এসব কথা শুনতেই চমকে উঠলাম। মনে কিছুটা ভয় জাগলো। আবার ভাবলাম সে তো আমার সাথে খারাপ কিছু করছে না। বললাম, ‘কেন এসেছো এমন নিষিদ্ধ জগতে? যেখানে শুধু শরীরের দাম পাওয়া যায়, মনের নয়।’
সে হালকা শ্বাস ফেলে বলল, ‘জীবনের ভুল। কিছু স্বপ্ন যা; ভাঙে আর কিছু মানুষের ব্যবহার; যা মানুষকে ঠেলে দেয় এ পথে।’ আমি আর কিছু বললাম না। শুধু শুনতে লাগলাম।

আরও পড়ুন
পঙ্কজ শীলের থ্রিলার: কালো নেকাব
জিও-এক্স সেভেন

নীরার চোখে জমে থাকা অদৃশ্য জল দেখতে পেলাম। সে বলল, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম এই শহর ছেড়ে পালাবো। তারপর বুঝলাম, পালালে কেউ থাকে না পাশে। শুধু রাত থাকে আর এই নীরব রাস্তাগুলো।’
আমি বললাম, ‘এখনো কি পালাতে ইচ্ছে করে তোমার?’
সে হেসে বলল, ‘ইচ্ছে করে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি সব হয়?’
তার হাসিটা কেমন তিক্ত, তবু অনেক সুন্দর।

আমাদের আলাপচারিতায় রাত আরও গভীর হলো। চারদিকে কুয়াশার ছাপ। আমি আস্তে বললাম, ‘আজ যদি তোমাকে বলি, তুমি অন্য জীবন শুরু করো, করবে?’
আমার কথায় নীরা কিছুক্ষল চুপ করে রইলো। তারপর মৃদু হেসে বলল, ‘তুমি কি আমায় নিতে চাও? এত সহজ নয় সোহান। সমাজের চোখ আছে, মানুষের মুখ আছে।’
আমি চোখ নামিয়ে বললাম, ‘আমার চোখে শুধু তুমি আর কিছু নেই।’

নীরা নীরব নিশ্চুপ। সে দূরের দিকে তাকায়, যেন কিছু মনে করতে চায়। কিছুক্ষণ পর নরম কণ্ঠে বলল, ‘আমরা এই রাতটুকু একসাথে হেঁটে যাই, চলবে? তারপর আমি হারিয়ে যাবো, তুমিও।’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘চলো।’

আমরা আবার হাঁটতে লাগলাম ফাঁকা রাস্তায়। কারো মুখে কথা নেই। তবু মনে হলো যেন হাজার গল্প বলা হয়ে গেছে। দুজন ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এক মোড়ে এসে থামলাম। নীরা বলল, ‘আমি এখানেই থাকি। তুমি যাবে?’
আমি বললাম, ‘তোমাকে দেখতে আসতে পারি?’
সে হেসে বলল, ‘না। আজকের রাতটাই থাক, স্মৃতি হয়ে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার আসল নামটা বলবে?’
নীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘সুরাইয়া।’

সে নিজের পথ ধরে হাঁটতে লগলো। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল অন্ধকার গলির মধ্যে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। তার লাল শাড়িটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। বুকে কেমন যেন এক শূন্যতা নিয়ে ফিরলাম। জানি, আর দেখা হবে না। তবু সেই রাতের মতো চুপিসারে আমার ভেতরে বেঁচে থাকবে সুরাইয়া।

এসইউ/এএসএম

Read Entire Article