লীলাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
লীলা নেই। কোথাও নেই।
না ঘুমে না জাগরণে। কোনো অবস্থাতেই লীলা আর হরিতের কাছে আসছে না।
লীলাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না গত দুদিন ধরেই।
হরিৎ বৃষ্টিকে তা জানালো অতি উদ্বেগের সঙ্গে। হরিতের মুখে এ কথা শুনে বৃষ্টির মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার লিপস্টিকে এঁকে তোলা ঠোঁটে। লাল বর্ণের লিপস্টিক গ্লিটারের কারণে জ্বলজ্বলে হয়ে নক্ষত্রের বিভা পেয়েছে। বৃষ্টিকে হাসতে দেখে হরিৎ ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যায় নিজের জায়গায়। মনে মনে রুষ্ট হয় বৃষ্টির প্রতি। তার এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে বৃষ্টি আমলেই নিলো না!
হরিৎ নিজের জায়গায় ফিরে গেলে বৃষ্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। শেষমেষ তাহলে আপদটা বিদেয় হলো! ওফ! কত কষ্ট করতে হয়েছে। কত কসরত রপ্ত করতে হয়েছে শুধু লীলাকে তাড়ানোর জন্য। হরিতের খালাতো বোন বৃষ্টি। হরিৎ থেকে বছর কয়েকের ছোট। কিন্তু চালাকি আর চাতুর্যে বৃষ্টি হরিৎকে পারলে এক হাটে বিক্রি করে আরেক হাটে কেনে। একবার শুধু নয়, গুনে গুনে দশবার এই বেচাকেনা সে করতে পারে। হরিতের সারল্যের বিপরীতে বৃষ্টি হলো জটিল জিলাপির মতো। কলেজে পড়ার সময় থেকেই বৃষ্টি হরিতে আসক্ত। হরিতের সবকিছুই বৃষ্টির কাছে ভালো লাগে। তবে মুখফুটে কখনও বলেনি। কিন্তু সামনে দেখা হলেই দুনিয়ার কর্কশ বাক্যে হরিৎকে সে আধামরা করে ফেলে। হরিৎ তাই পারতপক্ষে বৃষ্টির মুখোমুখি হতো না খালার বাড়ি গেলে কিংবা বৃষ্টি তাদের বাড়ি এলে।
কম কথা বলা হরিৎ ভাবনার জগতে বিচরণ করতো খুব। তার কলম চলতো কল্পনার সাথে পাল্লা দিয়ে। মাঝে মাঝে অনিন্দ্য সৃজনশস্যে ভরে উঠতো তার সাদা পৃষ্ঠাগুলো। বেশ কয়েকটা বইয়ের জনক সে। গল্পে হাত পাকালেও প্রবন্ধে তার মনোযোগ বেশি। আপনভুবনের হরিৎ কখন থেকে লীলার পাল্লায় পড়লো তা বৃষ্টি জানতে পারেনি। জানলে কি আর ব্যাপারটা এতটুকু গড়াতে দিতো? হরিতের লেখায় মাঝে মাঝে চন্দ্রাবতী হানা দিতো। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে দ্বিজ বংশীর কন্যা চন্দ্রাবতী। তার কোনো কোনো লেখায় এক নির্ঘাৎ আবশ্যকীয় চরিত্র হলো চন্দ্রাবতী। কখনও কখনও হরিৎ জয়ানন্দকে ভাগিয়ে দিয়ে নিজেকে তার জায়গায় কল্পনা করতো। বিষয়টা বৃষ্টি জানতো। হরিৎ যে বাংলায় পড়তো তা জেনে বৃষ্টির বেশ ভালো লাগতো। কারণ বৃষ্টি মনে করেছিলো, বাংলার পাঠ হরিৎকে আরও রোমান্টিক করে তুলবে। কিন্তু এরই মাঝে হরিৎ যে লীলায় আসক্ত তা কে বলবে।
মাস্টার্স পরীক্ষার শেষদিনে পরীক্ষা শেষে বন্ধুর সাথে মোটরসাইকেলে চেপে আসতে গিয়ে হরিৎ অ্যাক্সিডেন্টে হাত ভেঙে ফেলে। ক্লোজড টাইপ ফ্র্যাকচার হলেও প্লাস্টার করে হাতকে ইমমোবাইল করে রাখতে হবে কমপক্ষে একমাস। এই একমাস হরিৎ না চাইলেও গৃহবন্দি। ট্রায়াঙ্গুলার কলার স্লিং দিয়ে ভাঙা ডান হাত ঝুলিয়ে রাখলেও প্লাস্টার করা হাত নিয়ে বাইরে যাওয়া যায় না।
হরিতের গৃহবন্দিত্বকালে বৃষ্টির ফাইনাল প্রফ চলছিল। যারা মেডিকেল পড়াশোনার সাথে সংশ্লিষ্ট তারা জানে, এ পরীক্ষায় বাপের নাম থেকে শুরু করে নিজের নামও ভুলে যেতে হয়। এক একজন পরীক্ষক প্রশ্ন করে জেরবার করে ফেলেন। প্রতিটি পরীক্ষার্থীকে মনে হয় পরীক্ষার হলে আসামি হাজির। ফলে টানা দুমাস বৃষ্টি হরিতের খবর রাখতে পারেনি। বাসায় যাওয়া তো দূরে থাক। আপনি বাঁচলেই তো বাপের নাম। এত চাপের মধ্যেও যে হরিতের কথা তার মনে পড়েনি তা নয়। কিন্তু সে শুধু ওই মনে পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। তার টান আর বাড়তে দেয়নি।
হরিতের গৃহান্তরীণ দিনগুলোয় প্রথম প্রথম বন্ধুরা এসে আড্ডা দিয়েছিল কয়েকদিন। কিন্তু পরীক্ষা শেষে তারাও ছাড়া গরু হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরতে চলে গেছে। রেজাল্ট বের হলেই তো বেকারত্বের বোঝা চেপে বসবে সবার ঘাড়ে। প্রথম সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পরেই হরিতের কাছে লীলা আসতে শুরু করে। হরিৎ ঘুমোতে শুরু করলেই লীলা হাজির। লীলা এসে বসে থাকে না। বরং টেনে হরিৎকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। একদিন টানতে টানতে লীলা হরিৎকে পরির পাহাড়ে নিয়ে যায়। পরির পাহাড় নাম শুনে গা ছমছম করার দরকার নেই। লীলা হরিৎকে পাহাড়ে যেতে বলে। হরিৎ একটু অবাক হয়। এ যুগেও পরির পাহাড় আছে! লীলা বলে, পরির পাহাড় নামে আছে কিন্তু আসলে পরি নেই। বৃটিশ আমলে এ পাহাড়ের মালিক ছিলেন জন হ্যারি নামের এক পর্তুগিজ। পরে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন টেক্সরা হ্যারির কাছ থেকে পরির পাহাড়টি কিনে নেন। এরপর পেরেডার হাত হয়ে চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া মহকুমার ছনহরা গ্রামের জমিদার অখিল চন্দ্র সেন নয় হাজার টাকা দিয়ে পাহাড়টি কিনে নেন। লীলা থামলে হরিৎ বলে, কিন্তু পরিদের কথা আসলো কেন? হরিতের কথায় লীলা একটা রহস্যময় হাসি দেয়। হরিতের কাছে তখন মনে হয়, লীলার দেহে বুঝি কোনো পরি ভর করেছে। লীলা হরিৎকে অভয় দিয়ে বলে, পরিরা আদৌ ছিল কি না জানি না। তবে আগেকার দিনের লোকেরা মনে করতো পাহাড়ের শীর্ষে পরিরা রাত হলে নেমে আসে। যেহেতু তখন কোনো পাহাড়ের নাম ছিল না। তাই লোকজন এই আদালত ভবনের পাহাড়কেই বলতো পরির পাহাড়। মায়েরা তাদের সন্তানদের ঘুম পাড়ানোর জন্য তখন এই পরির পাহাড়ের ভয় দেখাতো।
পরির পাহাড়ে ভ্রমণ শেষে লীলা সেদিনের মতো বিদায় নিলেও এরপর থেকে প্রতিদিনই আসতো। একেকদিন একেক জায়গায় নিয়ে যেতো। এদিকে বৃষ্টি তখন চোখের গঠন, চোখের নানা রোগ, হৃদপিণ্ডের গঠন এবং এর নানা রোগ নিয়ে পড়তে পড়তে মুখে ফেনা ওঠার জোগাড়। হরিৎ তখন একেকদিন একেক পাহাড়ের পাঠ নিতে ব্যস্ত লীলার কাছে। লীলা মেয়েটা এত জানে কীভাবে? তা ভেবে ভেবে হরিৎ অবাক হয়। সেদিন লীলা এসে হরিতের হাতের কথা জিজ্ঞেস করে। একটু আলতোভাবে প্লাস্টারে হাত দিয়ে সন্তুষ্টির মাথা ঝাঁকায়। বলে, আমার মনে হয় তোমার ফ্র্যাকচারের ইউনিয়নটা বেশ ভালোই হচ্ছে। মাঝে মাঝে হাতের আঙুল কিন্তু নাড়াতে হয়। নইলে প্লাস্টার খোলার পর হাত চালু করতে বেকায়দা হবে। হরিৎ গলার স্বর বিকৃত করে বলে, তা আর আপনাকে বলতে হবে না পণ্ডিত মশায়। এটা ওই জংলি হবু ডাক্তার বৃষ্টি বলে দিয়েছে। হরিতের মুখে বৃষ্টির নাম শুনে লীলা ম্লান হয়ে যায়। তার কোথায় যেন বাজে। হরিৎ ব্যাপারটা খেয়াল করে। সে সরল হলেও বোকা নয়। লীলার মন খারাপকে উড়িয়ে দিতে হরিৎ বলে, তা আজ কোথায় নিয়ে যাবেন জ্ঞান দিতে? প্রসঙ্গান্তরের সহজ সুযোগ পেয়ে লীলা লুফে নিলো। বললো, চলো আজ জিলাপি পাহাড়ে যাই। হরিৎ অবাক হয়। বলো কি? পাহাড়ের নাম জিলাপিও হয়? লীলা বলে, আরে হয় হয়।
রিকশায় যেতে যেতে লীলা ছোটখাটো একটা লেকচার দেয় হরিৎকে। লীলা বলতে থাকে, আসলে শহরের বাটালি পাহাড়কেই জিলাপি পাহাড় বলে। কারণ বাটালি পাহাড়ে ওঠার পাহাড়ি রাস্তাটিকে জিলাপির প্যাঁচের মতো দেখায়। তাই একে জিলাপি পাহাড় বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাটালি পাহাড়ের চূড়ায় বিমান বিধ্বংসী কামান স্থাপন করা হয়েছিল। অনেক বছর পূর্বে দূর সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের দিক নির্দেশনার জন্য বাটালি পাহাড়ের ওপর একটি বাতিঘরও ছিল। কথা বলতে বলতে রিকশায় করে সিআরবির নান্দনিক সবুজ পেরিয়ে হরিৎ ও লীলা পৌঁছে যায় জিলাপি পাহাড়ে। প্যাঁচ ঘুরে উপরে উঠতে উঠতে তারা শীর্ষে পৌঁছে যায়। দেখে শতায়ু অঙ্গনের ফলক। মনে হয় এরা ভোরের ব্যায়াম সারতে এখানে আসে। হরিৎ ওপর থেকে নগরীর সৌন্দর্য পাখির চোখে দেখে বলে উঠলো, ওয়াও! হরিতের আনন্দ দেখে লীলারও পেট ভরে যায়। হরিৎ চেয়েছিল ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের মতো দুহাত প্রসারিত করে একটা ছবি তোলে। কিন্তু ভাঙা হাতে প্লাস্টারের কারণে হরিতের সে আবেগকে প্রকাশ করা যায়নি।
জিলাপি পাহাড়ে তাদের আর বেশি সময় লাগেনি। নামতে নামতে লীলা প্রস্তাব দেয়, এত তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে কী করবে। চলো আমরা রাজা পাহাড় দেখতে যাই। হরিৎ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। সে তো লীলার ছাত্র আজ। তাই তার কোনো নিজস্ব মতামত নাই। হরিতের সায় পেয়ে লীলা রিকশায় চলে আসে রাজা পাহাড়ের কাছে। ওমা! এ যে দেখছি ডিসি হিল! হরিৎ বিস্ময়ে বলে ওঠে। লীলা বলে, এটা তো সেদিনকার ডিসি হিল। ইংরেজ শাসনামলের গোড়ার দিকে এখানে চাকমা রাজার বাসস্থান ছিল। এজন্যই একে রাজা পাহাড় বলে। পাহাড়টি জাফর আলী নামে এক ব্যক্তির মালিকানায় ছিল একসময়। এজন্য একে জাফর আলী হিলও বলে কেউ কেউ। পাহাড়ের ওপরে উঠে একটা হেলিপ্যাড দেখতে পেলো হরিৎ। মনে মনে লীলাকে ধন্যবাদ জানায়। শহরে থাকে অথচ অনেক কিছুই দেখা হয়নি। রাজা পাহাড় দেখা শেষে আসতে আসতে রিকশা ভ্রমণে চোখে পড়ে কাটা পাহাড়, চেরাগী পাহাড় মোড়, জয় পাহাড়, পার্সিভ্যাল হিল নামের ঐতিহাসিক স্থানগুলো। পায়ে টানা রিকশা, তাই গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় একটু বেশি লাগে। রিকশায় বসে বসে লীলা হরিতকে পাহাড়ের পাঠ দেয়। আন্দরকিল্লা হয়ে আসার সময় জেনারেল হাসপাতাল দেখে লীলা বলে, এটাকে বলে রংমহল পাহাড়। এ পাহাড়ে জেনারেল হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করার সময় একটা বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। মূর্তিটাকে নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারে আলাদা একতলা ভবন তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। একে পুণ্যার্থীরা বাটালি বুদ্ধ নামে অভিহিত করে। যদিও এ বুদ্ধমূর্তি কারও কাছে বুড়া গোঁসাই, কারও কাছে সত্য বুদ্ধ নামে পরিচিত। প্রবর্ধিত এ অংশকে বুড়া গোঁসাই মন্দিরও বলে। হরিৎ এ না জানা সত্যটুকু জানতে পেরে মনে মনে লীলার কাছে কৃতজ্ঞ হয়। লীলার বদৌলতেই সে জানতে পারলো, পার্সিভ্যাল হিল এবং রংমহল পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। উনিশশ’ সাত সালের জুন মাসে। আহা! সে সময় যদি জন্মাতো হরিৎ! রবীন্দ্রনাথকে অন্তত একবার হাতে ছুঁয়ে দেখা যেতো। কিন্তু মানুষ ভাবলেই কি আর সব পেয়ে যায়!
রিকশায় চলতে চলতে হরিৎ খেয়াল করে, এ প্রথম লীলা তার হাত ধরে। কেমন যেন হরিতের অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি হয়। লীলা অনেক বেশি স্নিগ্ধ, বাকে-বচনে পরিমিত। সেদিনের মতো রৌদ্রক্লান্ত হয়ে তাদের শহর পরিক্রমা শেষ হয়। লীলা বিদায় নেয় হরিতের কাছ থেকে। ক্লান্ত হরিৎ ঘুমিয়ে পড়ে নিস্তেজ হয়ে। দুপুরের খাবার খেতে ডাকতে এসে হরিতের মা দেখেন, ছেলে ঘুমিয়ে গেছে। তিনি কপালে হাত দিয়ে দেখেন। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। মনে মনে স্বপ্ন দেখেন, একদিন তার ঘরে ফুটফুটে এক পরির মতো বউ আসবে ছেলের হাত ধরে। মধ্যবিত্ত মায়েরা স্বপ্ন দেখেই বাঁচেন। অনাগত সুখের স্বপ্ন, পুষ্পশোভিত মালঞ্চের মতো ভরা সংসারের স্বপ্ন। কখনও কখনও সময় তাদের সেই স্বপ্নে মাধুরী মেশায়, কখনও কখনও তা কাচের টুকরোর মতো খান খান করে ভেঙে দেয়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ে ডাক দেয়, ও হরিৎ, ও বাবা, ওঠ ওঠ। বেলা পড়ে গেলো। চল ভাত খাবি, ভাত দিছি।
আরও পড়ুন
লাল শাড়ি ও রাতের গল্প
এক শরতের গল্প
বৃষ্টির মাথা ঠিক নেই। সবেমাত্র লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কোনোমতে পাস করবে টেনেটুনে। প্রশ্ন হয়েছে লেকচারার স্টাইলে। অর্থাৎ লেকচারারদের প্রশ্ন করতে দিলে তারা কী জানেন তা জাহির করেন। আর প্রফেসররা প্রশ্ন করলে পরীক্ষার্থী কী জানে তা তারা বের করেন। এ কারণেই পরীক্ষা কঠিন হয়েছে। এখন হলো সবচেয়ে কঠিন সময়। ভাইভা আর প্র্যাকটিক্যাল। রোগীগুলো একটার চেয়ে একটা সেয়ানা। তারা জেনে গেছে, ওনারা সাহায্য করলেই কেবল ছাত্র-ছাত্রীরা পাস করতে পারে। নচেৎ নয়। একবার তো এমন হয়েছে, এক ছাত্র রোগীকে জিজ্ঞেস করে হিস্ট্রি নিয়ে তার কেইস রেডি করেছে। পরীক্ষক এসে জিজ্ঞেস করলেন, হিস্ট্রি নিয়েছো? জ্বী স্যার, ছাত্র জবাব দেয়। ফট করে রোগী বলে দিলো, স্যার উনি মিছা কইতাছেন। আমারে কিছু না জিগাইয়াই উনি সব লেইখ্যা ফ্যালাইছেন। বলা বাহুল্য, এরপর ওই ছাত্রের ওপর স্যারের ইমপ্রেশন খারাপ হয়ে গেলো। ছেলেটা আর পাস করতে পারলো না। তাই রোগীদের ঠিক রাখতে জুস-বিস্কুট খাওয়াতে হয়। নইলে বিগড়ে যায়। বৃষ্টি তার রোল নম্বরের আগে-পিছে তিন-চারজনসহ ওয়ার্ডে পড়ে আছে প্র্যাক্টিক্যালের জন্য। কখন সিএ কিংবা রেজিস্ট্রার সময় দেবেন ডেমোনেস্ট্রেশন করতে। নাওয়া-খাওয়া সব তার হাসপাতালেই। হরিৎ তো দূরের কথা, নিজের মায়ের খবরও সে নিতে পারছে না। এ ফাঁকে লীলার দখলে চলে গেছে সম্পূর্ণ হরিৎ।
হরিতের হাত ধরার পর থেকে লীলার মন উচাটন থাকে। লীলা সব সময় তক্কে তক্কে থাকে কখন হরিতের কাছে যাবে। কিন্তু লীলা চাইলেই যেতে পারে না। হরিৎকেই চাওয়া লাগে। হরিৎ আকাঙ্ক্ষা করলেই কেবল লীলা আসে। হরিতের হাতে হাত রেখে লীলা যেন আরও বেশি মানবীয় হয়ে উঠেছে। মনে হয় হাতে হাত ধরে তাদের দুজনের মধ্যে কিছু চার্জের বিনিময় হয়েছে। এই চার্জের মধ্যে মানবিক প্রণয়ের রসায়ন কার্যকর হয়েছে। নয়তো এ কয়দিন লীলার মনে হরিৎকে দেখার কোনো আকুলি-বিকুলি তৈরি হয়নি। তাই আজ হরিৎ চাইতে না চাইতেই লীলা হাজির। লীলা যেন দরোজার ওপারে ছিল। ডাক দিলেই উপস্থিত। হরিৎকে পাহাড় দেখানো লীলার যেন একটা কৌশল। যাতে সে বেশিক্ষণ হরিতের সঙ্গ পায়। লীলা কাছে থাকলে হরিতেরও কোনো ক্ষুধা-তৃষ্ণা লাগে না।
আজ লীলা এসে হরিৎকে নিয়ে গেলো কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে। হরিৎ কখনও সাঁতার শেখেনি। ছোটবেলায় পুকুরে নামলেই হরিৎকে মা বেতের ভয় দেখিয়ে উঠে আসতে বাধ্য করতো। একটাই ছেলে কি না। পুকুরে নেমে মায়ের অগোচরে অনেক শিশু সে সময় বেকায়দায় পড়তো। কয়েকজনের তো যমে-মানুষে টানাটানি ছিল। এ কারণে মায়ের অধিক মমতায় হরিৎ সাঁতার জানা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে লীলা থাকায় হরিতের আর ভয় লাগছে না। হরিৎদের সাম্পান ঘেঁষে চলে গেছে একটা জাহাজ। বহির্নোঙরে আসা জাহাজগুলোর একটা হবে হয়তো। উরিব্বাস! সে কী ঢেউ! একবার আসমানে তোলে তো আরেকবার পাতালে ফেলে। হরিতের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ে মায়ের মুখ স্মরণ করে নিজেকে ঠিক রাখলো। কোনোমতে কূলে ভিড়েই হরিতের ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়লো।
লীলা আজ দেয়াঙ পাহাড়ে এসেছে মূলত ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানতে। চট্টগ্রামের দেয়াঙ পাহাড় বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক পাহাড়। এটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী আনোয়ারা-কর্ণফুলীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এ অঞ্চলেই আরাকানিদের চাটিগাঁ দুর্গ ও দেয়াঙ কারাগার অবস্থিত ছিল, যে কারাগারে পনেরোশ খ্রিষ্টাব্দে মহাকবি আলাওল আরাকানিদের হাতে ধরা পড়ে বন্দি ছিলেন। ধারণা করা হয়, চট্টগ্রামের প্রাচীন পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় এই দেয়াঙ পাহাড়ে অবস্থিত ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, আজকের কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের দেয়াঙ পাহাড়ের বিশ্বমুড়া নামক স্থানে আরাকান রাজা বিক্রমের বাড়ি ছিল। লীলার মুখে ইতিহাস শুনে হরিৎ অবাক হয়। নালন্দার পরে এই পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পাল আমলে এক অন্যতম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে উৎখনন করতে পেরে হরিতের আনন্দ হয়। হরিৎ আপনমনে ভাবে, আহা! ইউরোপ-আমেরিকা নয়, আমাদের জন্মভূমিতেই ছিল জ্ঞানচর্চার আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে চীন থেকেও শিক্ষার্থী আসতো জ্ঞানার্জনে!
লীলার সাথে ঘুরতে ঘুরতে হরিতের আর ফাইনাল পরীক্ষার পাকেচক্রে বৃষ্টির একমাস দ্রুত কেটে গেলো। হরিতের ভাঙা হাতের এক্সরে করা হলো। লীলা যা বলেছিল তাই। তার হাতের ক্লোজড্ ফ্র্যাকচার প্রত্যাশা মতো কোনো ক্যালাস তৈরি না করে ইউনিয়ন হয়ে গেছে। এতে হরিতের ব্যথা বা ঝিন্ ঝিন্ ভাব লাগবে না। এটা বড়ই সুখবর। ঝাড়া হাত-পা হয়ে হরিৎ এখন লীলার সাথে বের হতে পারে। লীলার কারণে নগরীর সব পাহাড় তার দেখা ও চেনা হয়ে গেছে। মাস্টারদার স্মৃতি বিজড়িত জালালাবাদ পাহাড়টা বাকি ছিল এতদিন। আজ প্লাস্টারমুক্ত হয়ে দেখে এলো পাহাড়টা। উনিশশ তিরিশ সালের বাইশে এপ্রিল এখানে ইংরেজদের সাথে মাস্টারদার বিপ্লবী বাহিনীর ঘোরতর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে তেরো জন বিপ্লবী শহীদ হন। লীলার মুখে মাস্টারদার বাহিনীর বীরত্ব ও বলিদানের কথা শুনে হরিৎ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়। তার রোমে শিহরণ তৈরি হয়। হরিৎ মনে মনে মাস্টারদার বিপ্লবী বাহিনীর প্রতি লাল স্যালুট জানায়।
বৃষ্টির পরীক্ষা শেষ। ফলও বের হলো। বৃষ্টি পাস করেছে এমবিবিএস ফাইনাল প্রফে। তাদের ইন্টার্নশিপ শুরু হয়ে গেছে। ফলাফল বের হওয়ার পরে একদিন এসেছিল খালার বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে। এসে হরিৎকে দেখে যায়। অনেকদিন পরে হরিৎকে দেখে বৃষ্টির মনে সন্দেহ তৈরি হয়। হরিৎকে কেন যেন চোর চোর মনে হয়। কিছু একটা লুকোচ্ছে। একা একা বিড়্ বিড়্ করে থেকে থেকে। বৃষ্টি বিষয়টা মাথায় নিয়ে ভাবতে ভাবতে চলে যায়। তার তাড়া ছিল সেদিন। আরও কয়েকটা বাসায় মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে যেতে হবে। পাসের মিষ্টি। সবাই আশা করে আছে মিষ্টি নিয়ে বৃষ্টি যাবে। তাই খালার সাথে আর বেশি কথা বলা গেলো না। তবে ব্যাপারটা সে মাথা থেকে ফেলে দেয়নি।
ইন্টার্নশিপ শুরু হওয়ার একমাস পরে বৃষ্টির ওয়ার্ড শুরু হয় সাইকিয়ার্ট্রিতে। এখানে সব মানসিক রোগী। নানা রকম। কেউ বিষণ্ন, কেউ অতি উত্তেজিত। কেউ আত্মহননের প্রবণতায় বার বার চেষ্টা করে ব্যর্থ, কেউ আবার ছুরি নিয়ে অন্য কাউকে মারতে ছোটে। কারও কারও থেকে থেকে বিলাপের কান্না অট্টহাস্য হয়ে যায় আর কেউ কেউ স্লোগান তুলে রাজনীতির মঞ্চে বক্তা হয়ে যায়। কারও কারও পরিধেয় মলিন, আর কারও বেশভূষায় রুগ্নতার কোনো ছাপ নেই। কেউ কেউ রজ্জু দেখে সাপ ভাবে, কেউ ভাবে তার পানিতে কেউ বিষ মিশিয়েছে। কারও আতঙ্ক, ঘরের বের হলেই তাকে মেরে ফেলবে; আর কেউ ভাবে তাকে স্রষ্টা স্বয়ং পাঠিয়েছেন মানুষকে মুক্ত করতে। কারও মনে সন্দেহ হয়, আশেপাশের সবাই তাকে নিয়ে কানাঘুষা করে। আর কেউ কেউ বউকে সন্দেহ করে পরকীয়ায়। তরুণ কেউ কেউ প্রেমে প্রতারিত হয়ে ভারসাম্য হারা, আর কেউ পারিবারিক নির্যাতনে অস্বাভাবিক। হরেক রকম মানসিক বৈকল্যের মানুষের ভিড়ে বৃষ্টি ধীরে ধীরে পেকে উঠছে মানুষের মনোদৈহিক রোগের চিকিৎসক হিসেবে।
একদিন ঘরে ফিরে রাতে বৃষ্টি তার খালার ফোন পেলো। উদ্বিগ্ন খালা যা বললো তাতে তার মানসিক রোগের ওয়ার্ডের রোগীদের সাথে সব উপসর্গ মিলে যায়। বলা বাহুল্য, এসব উপসর্গ হরিতের মাঝে দেখতে পেয়েছেন তার মা। বৃষ্টি খালাকে অভয় দিয়ে বলে, তুমি কিছু ভেবো না খালা। আগামীকাল আমি হাসপাতালে যাওয়ার সময় হরিৎ ভাইকে নিয়ে যাবো মেডিকেলে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হরিতের মা। পরদিন সকালে আটটার দিকে কথামতো বৃষ্টি আসে হরিতের বাসায়। জোর করে পোশাক পাল্টিয়ে তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে। তার ওয়ার্ডে প্রফেসরকে দেখায়। প্রফেসর সবকিছু জেনেবুঝে বললেন, হরিৎ সিজোফ্রেনিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত। তাকে ওয়ার্ডে ভর্তি দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
সেই থেকে আজ পনেরো দিন হতে চললো হরিৎ মানসিক রোগের ওয়ার্ডে পুরুষ বিভাগে ভর্তি আছে। বৃষ্টি তার দৈনিক ডিউটিতে হরিৎকে দেখে যায়। প্রথম প্রথম তাকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অবশ্য সবার ক্ষেত্রেই তা হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিড়্ বিড়্ করাটা বন্ধ হয়েছে। ভর্তির পর থেকে আজ পনেরোতম দিন শেষে বৃষ্টি হরিৎকে লীলামুক্ত করতে পেরেছে। যেহেতু হরিৎ নিজেই বলেছে, গত দুদিন ধরে লীলা আর আসছে না। সুতরাং হরিৎ এখন সম্পূর্ণ বৃষ্টির। লীলা নামে নিজের তৈরি করা কাল্পনিক নারী চরিত্র আর হরিতের কল্পনায় আসে না। না ঘুমে না জাগরণে।
বৃষ্টি আজ খুব খুশি। আজ থেকে হরিৎ কেবলই বৃষ্টির। আগত সুদিনের পরিকল্পনায় মগ্ন বৃষ্টির মোবাইলে হঠাৎ মেসেজ আসার বিপ্ বেজে ওঠে। বৃষ্টি কপাল কুঁচকে তার অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মেসেজ অপশনে চোখ মেলে দেখে অচেনা এক নাম্বার থেকে এসএমএস: আমার হরিৎকে তোমার কাছে দিয়ে গেলাম বৃষ্টি। মনে রেখো, আগামী জন্মে সে কিন্তু আমার।
এসইউ/জিকেএস

2 hours ago
5








English (US) ·