শত্রুর জন্য মহানবীর (সা.) দোয়া

মুফতি ইফতেখারুল হক হাসনাইন মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো শত্রুর অকল্যাণ চাওয়া, শত্রুর অকল্যাণে খুশি হওয়া, শত্রুর জন্য বদ-দোয়া করা। কিন্তু মহানবী (সা.) নিজের শত্রুদের জন্য বদ দোয়া তো করতেনই না, বরং সব সময় তিনি তাদের কল্যাণের জন্য দোয়া করতেন। যারা তাকে গালি দিত, যারা ছিল তার রক্তের পিপাসু, তাদেরও কল্যাণ চাইতেন তিনি। হিজরতের আগে মক্কায় মুসলমানদের ওপর এবং রাসুলুল্লাহর (সা.) ওপর যে নিরবচ্ছিন্ন নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সেই ইতিহাস স্মরণ করলেও হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সেই সময় সাহাবি হযরত খাব্বাব ইবনে আরত (রা.) নবীজিকে (সা.) অনুরোধ করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শত্রুদের জন্য বদদোয়া করুন। এ কথা শুনে নবীজির (সা.) চেহারা মোবারক রাগে লাল হয়ে উঠেছিল। (সহিহ বুখারি: ৩৮৫২) পরে আবার কয়েকজন সাহাবি একই ধরনের প্রস্তাব করলে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমাকে দুনিয়ার জন্য লানত নয়, বরং রহমত হিসেবে পাঠানো হয়েছে। (সহিহ মুসলিম: ২৫৯৯)। মক্কাবাসীর জন্য দোয়া হিজরতের আগে মক্কার কোরায়শরা তিন বছর নবীজি (সা.), তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের আবু তালিব উপত্যকায় অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, এ সময় তারা অনাহারে অনেক কষ্ট পে

শত্রুর জন্য মহানবীর (সা.) দোয়া

মুফতি ইফতেখারুল হক হাসনাইন

মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো শত্রুর অকল্যাণ চাওয়া, শত্রুর অকল্যাণে খুশি হওয়া, শত্রুর জন্য বদ-দোয়া করা। কিন্তু মহানবী (সা.) নিজের শত্রুদের জন্য বদ দোয়া তো করতেনই না, বরং সব সময় তিনি তাদের কল্যাণের জন্য দোয়া করতেন। যারা তাকে গালি দিত, যারা ছিল তার রক্তের পিপাসু, তাদেরও কল্যাণ চাইতেন তিনি।

হিজরতের আগে মক্কায় মুসলমানদের ওপর এবং রাসুলুল্লাহর (সা.) ওপর যে নিরবচ্ছিন্ন নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সেই ইতিহাস স্মরণ করলেও হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সেই সময় সাহাবি হযরত খাব্বাব ইবনে আরত (রা.) নবীজিকে (সা.) অনুরোধ করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শত্রুদের জন্য বদদোয়া করুন। এ কথা শুনে নবীজির (সা.) চেহারা মোবারক রাগে লাল হয়ে উঠেছিল। (সহিহ বুখারি: ৩৮৫২)

পরে আবার কয়েকজন সাহাবি একই ধরনের প্রস্তাব করলে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমাকে দুনিয়ার জন্য লানত নয়, বরং রহমত হিসেবে পাঠানো হয়েছে। (সহিহ মুসলিম: ২৫৯৯)।

মক্কাবাসীর জন্য দোয়া

হিজরতের আগে মক্কার কোরায়শরা তিন বছর নবীজি (সা.), তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের আবু তালিব উপত্যকায় অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, এ সময় তারা অনাহারে অনেক কষ্ট পেয়েছেন। কোরায়শের এ অপকর্মের শাস্তি হিসেবে পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর থেকে রহমতের মেঘ তুলে নেন। মক্কায় এত কঠিন দুর্ভিক্ষ আসে যে, লোকেরা হাড় ও মরা জন্তু খেতে শুরু করে। আবু সুফিয়ান তখন মহানবীর (সা.) খেদমতে হাজির হয়ে বলেন, মুহাম্মাদ! তোমার জাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করো, এই বিপদ দূর হোক। মহানবী (সা.) তখনই মক্কার অধিবাসীদের জন্য দোয়া করেন। মহানবীর (সা.) দোয়ার বরকতে আল্লাহ তাআলা মক্কাবাসীকে ওই  বিপদ থেকে মুক্তি দেন। (সহিহ বুখারি: ১০০৭, সহিহ মুসলিম: ১৭৯৫)

ওহুদের যুদ্ধে রক্তাক্ত করার পরও দোয়া

ওহুদের যুদ্ধে শত্রুরা প্রিয় নবীজির (সা.) ওপর পাথর নিক্ষেপ করল, তীর ছুড়ল, তলোয়ার চালাল, দাঁত মোবারক শহীদ করল, পবিত্র কপাল রক্তাক্ত করল। কিন্তু রক্তাক্ত অবস্থায়ও মহানবী (সা.) শত্রুর জন্য বদ দোয়া না করে তাদের হেদায়াতের জন্য দোয়া করেছিলেন। বলেছিলেন, হে আল্লাহ! আমার জাতিকে হেদায়াত দান করুন, কারণ তারা জানে না। (সহিহ বুখারি: ৩৪৭৭)

তায়েফবাসীর জন্য দোয়া

তায়েফবাসী ইসলামের দাওয়াতের জবাব দিয়েছিল উপহাস ও বিদ্রূপ দিয়ে, নবীজিকে (সা.) আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে পাথর মেরে তার পবিত্র পা মোবারক তারা রক্তাক্ত করেছিল—তাদের ব্যাপারে ফেরেশতা এসে জিজ্ঞেস করলেন, হুকুম করুন, আমরা দুটো পাহাড় তাদের ওপর উল্টে দিই? নবীজি (সা.) বললন,  না। তারা ইমান না আনলেও হয়তো তাদের বংশধররা ইমান আনবে।

দশ-বারো বছর পর সেই তায়েফই আবার যুদ্ধে মুসলমানদের প্রচুর ক্ষতি করছিলো, তখন সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! তায়েফবাসীর জন্য বদদোয়া করুন।’ 

নবীজি হাত তুললেন। সাহাবিরা ভাবলেন এবার হয়তো নবীজি (সা.) বদদোয়াই করবেন। কিন্তু নবীজির (সা.) পবিত্র মুখ থেকে বের হলো, হে আল্লাহ! তায়েফবাসীকে ইসলাম গ্রহণ করার তওফিক দান করুন। (সহিহ বুখারি: ৩২৩১, সিরাতে ইবনে হিশাম: ২/২৯)

দাওস গোত্রের জন্য দোয়া

দাওস গোত্র ইয়েমেনে বসবাস করত। তোফায়েল ইবনে আমর আদ-দাওসী (রা.) ছিলেন তাদের সর্দার এবং মুসলিম। তিনি দীর্ঘদিন নিজের গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা কুফরে অটল ছিল। অবশেষে তোফায়েল ইবনে আমর আদ-দাওসী (রা.) নবীজির (সা.) কাছে এসে গোত্রের অবস্থা বর্ণনা করে বললেন, তাদের জন্য বদ দোয়া করুন। উপস্থিত লোকজন  শুনে মনে মনে বলল, এবার দাওস গোত্রের ধ্বংস নিশ্চিত। কিন্তু রহমতের নবী (সা.) দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! দাওস গোত্রকে হেদায়াত দিন এবং তাদেরকে (ইসলামের দিকে) নিয়ে আসুন। (সহিহ মুসলিম: ২৫২৪)

আবু হোরায়রার (রা.) মুশরিক মায়ের জন্য দোয়া

সাহাবি আবু হোরায়রার (রা.) মা মুশরিক ছিলেন। আবু হোরায়রা (রা.) মাকে যতই ইসলামের দাওয়াত দিতেন, মা ততই বিরোধিতা করতেন। একদিন তিনি দাওয়াত দিলে তার মা রাসুলুল্লাহর (সা.) ব্যাপারে অপমানজনক কথা বললেন। এতে আবু হোরায়রা (রা.) এত দুঃখ পেলেন যে কাঁদতে কাঁদতে নবীজির (সা.) কাছে এলেন এবং ঘটনা বললেন। নবীজি (সা.) দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আবু হোরায়রাহর মাকে হেদায়াত দিন।

আবু হোরায়রা (সা.) খুশি মনে বাড়ি ফিরে দেখলেন, তার মা গোসল করে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। (সহিহ মুসলিম: ২৪৯১)

মুনাফিক সরদারের জন্য দোয়া

আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ছিলেন মদিনার মুনাফিকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানদের ক্ষতি করার কোনো সুযোগই তিনি হাতছাড়া করতেন না। কাফের কুরাইশদের সাথে তার গোপন যোগাযোগ ছিল। ওহুদ যুদ্ধে নবীজির (সা.) সঙ্গে যুদ্ধের জন্য বের হলেও ময়দানে পৌঁছার আগেই নিজের অনুসারীদের নিয়ে তিনি আলাদা মদিনায় ফিরে গিয়েছিলেন। ইফকের ঘটনায় হজরত আয়েশার (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি অতি-উৎসাহী ছিলেন।

এই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মারা গেলে নবীজি (সা.) তার জানাজার নামাজ পড়ালেন। হজরত ওমর (রা.) আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি তার জানাজা পড়াতে যাচ্ছেন, অথচ সে এটা করেছে, ওটা করেছে। ওমরের (রা.) কথা শুনে নবীজি (সা.) মুচকি হেসে বললেন, সরে দাঁড়াও, হে ওমর! এরপরও ওমর (রা.) বার বার আপত্তি করতে থাকলে নবীজি (সা.) বললেন, যদি আমাকে বলা হতো, তার জন্য সত্তরবার প্রার্থনা করলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে, তাহলে আমি তাই করতাম। (সহিহ বুখারি: ৪৬৭০, সহিহ মুসলিম: ২৭৭২)

লেখক: মুহাদ্দিস, দারুল উলুম মাকবুলিয়া মাদরাসা, দেবিদ্বার, কুমিল্লা

ওএফএফ

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow