শব্দ কুঠার

পড়ার ঘরে টেবিলের ওপর ঝুঁকে মগ্ন হয়ে লিখছিলাম । ঘরের তিন দিক আঁধারে ডুবে না থাকলেও অন্ধকারের নিস্তব্ধতা যেন ঝিমঝিম নীরব স্বর ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু দেখলাম টেবিল-ল্যাম্পের কড়া আলো উপেক্ষা করে রোলটানা খাতার ভেতর থেকে সৃজিত শব্দরা উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে, পুরো ঘর আলোকিত করে রেখেছে । ওদের চোখের কড়া আলোর পরশ পেয়েও শান্তি পাচ্ছি না। হঠাৎ শুনলাম দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। দরজা কি লক করে রেখেছি? প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে হালকা আলোতেও দেখলাম হুক লাগানো। না উঠে প্রশ্ন করলাম, \'কে ? \'আমি কাফকা।\' \'কোন্ কাফকা?\' \'চেক লেখক, ফ্রানৎস কাফকা।\' \' বলো কী? তিনি তো ১৮৮৩ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন আর ১৯২৪ সালে মারা গেছেন।\' \' কে বলল আমি মারা গেছি? দরজা খোলো।\' \'ওপারের পৃথিবী থেকে কীভাবে এলে তুমি? তুমি তো মরে গেছ ! ভূত হয়ে এসেছ? \' ভূত নয়, শব্দস্রোতে ভেসে আছি আমি। ঢেউ হয়ে উজানে ফিরে আসি তোমাদের দ্বারে, ভাটিতে চলে যাই গভীর সাগরপানে।\' \'ওরে বাবা! কেবল তো রূপক-আশ্রয়ী গদ্যে নয়, তুমি তো দেখছি কবিতার স্বরেও কথা বলতে পারো।\' \'প্রশংসা তুলে রাখো, দেখো, মাথা উঁচিয়ে সামনে দেখো। তোমার টেবিলের সামনে শোভা পাচ্ছ

শব্দ কুঠার

পড়ার ঘরে টেবিলের ওপর ঝুঁকে মগ্ন হয়ে লিখছিলাম ।
ঘরের তিন দিক আঁধারে ডুবে না থাকলেও অন্ধকারের নিস্তব্ধতা যেন ঝিমঝিম নীরব স্বর ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু দেখলাম টেবিল-ল্যাম্পের কড়া আলো উপেক্ষা করে রোলটানা খাতার ভেতর থেকে সৃজিত শব্দরা উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে, পুরো ঘর আলোকিত করে রেখেছে । ওদের চোখের কড়া আলোর পরশ পেয়েও শান্তি পাচ্ছি না।
হঠাৎ শুনলাম দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ।
দরজা কি লক করে রেখেছি? প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে হালকা আলোতেও দেখলাম হুক লাগানো।
না উঠে প্রশ্ন করলাম, 'কে ?
'আমি কাফকা।'
'কোন্ কাফকা?'
'চেক লেখক, ফ্রানৎস কাফকা।'
' বলো কী? তিনি তো ১৮৮৩ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন আর ১৯২৪ সালে মারা গেছেন।'
' কে বলল আমি মারা গেছি? দরজা খোলো।'
'ওপারের পৃথিবী থেকে কীভাবে এলে তুমি? তুমি তো মরে গেছ ! ভূত হয়ে এসেছ?
' ভূত নয়, শব্দস্রোতে ভেসে আছি আমি। ঢেউ হয়ে উজানে ফিরে আসি তোমাদের দ্বারে, ভাটিতে চলে যাই গভীর সাগরপানে।'
'ওরে বাবা! কেবল তো রূপক-আশ্রয়ী গদ্যে নয়, তুমি তো দেখছি কবিতার স্বরেও কথা বলতে পারো।'
'প্রশংসা তুলে রাখো, দেখো, মাথা উঁচিয়ে সামনে দেখো। তোমার টেবিলের সামনে শোভা পাচ্ছি আমি।'
মাথা তুলে ভালো করে দেখে শুনে বললাম, 'সত্যিই তো, তোমার ফ্ল্যাশফিকশন, অনুগল্পের অনুবাদ শোভা পাচ্ছে একেবারে চোখের সামনে।'
কথা শেষ করে টেবিল ছেড়ে সামনে এগোতে গিয়ে পায়ে জড়তা টের পেলাম। তবু দরজা খুলে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে চমকে গেলাম। বাইরে কেউ নেই।

'নিষ্ঠুরতা নয়। তোমার শব্দ কুঠার থেকে ধারালো বই রচিত হবে। সেটা যখন মানুষ পড়বে তখন তার ভেতর জমে থাকা নিষ্ঠুরতা-হিংস্রতার জমাট সমুদ্রবরফ ভেঙে যাবে। সেখান থেকে জেগে উঠবে হৃদয়বান মানুষ, যে মানুষের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মানবিক বোধসম্পন্ন মানবজাতি আর ওপারের আমরাও।'

'কই তুমি?'
'আমি তো তোমার টেবিলেই।'
'বলো কী ? সেখানে তো তোমার বই ছাড়া আর কিছুই নেই। তোমার কোনো ছবিও নেই ।'
' আছে, বইয়ের মলাট ওল্টাও । ছবিটা খুঁজে পাবে। তবে ওই ছবির মধ্যে আমার কোনো প্রাণ নেই।'
'তো, প্রাণ কোথায়? কীভাবে কথা বলছো, একবার দরজার বাহির আবার টেবিলের সামনে থেকে?’
"ওটাই আমার বৈশিষ্ট্য। আমার প্রাণ লুকিয়ে আছে আমার সৃষ্ট শব্দের মধ্যে। ওরা 'আমি-হয়ে' আমার কথা বলছে।"
হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম পড়ার সেলফের দিকে। লিখতে বসার আগে পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে রাখা ধুলোবালিমুক্ত মুম রহমান অনূদিত 'অণুগল্প/ কাফকা অনুবাদ' (অনার্য, প্রথম প্রকাশ ২০১৭) বইটির দিকে।
'তো এখন শব্দ থেকে কীভাবে কথা ফুটে বেরোচ্ছে? এ সময়ে কেন হাজির হলে আমার টেবিলে?'
'তোমার লেখার মগ্নতায় ত্রুটি দেখতে পাচ্ছি। দরজায় কড়া নাড়া শব্দের দিকে নজর গেছে তোমার। অর্থাৎ তুমি গভীর মগ্নতায় ডুবে যেতে পারোনি। জীবনের উপরের সারফেসে ভেসে থাকলে ভেতরের তলে ঢোকার সম্ভাবনা কমে যায়। কথাটা বলতে এসেছি, জেগে উঠেছি আমার শব্দের ভেতর থেকে। বলতে চাই কলমটাকে কুঠারে পরিণত করো। তোমার শব্দকুঠার চালাবে মানুষের মগজে।'
'নরম মগজ তো থেঁতলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাবে। এমন নিষ্ঠুর হব কীভাবে, বলো। আমিতো নরম মনের মানুষ।'
'নিষ্ঠুরতা নয়। তোমার শব্দ কুঠার থেকে ধারালো বই রচিত হবে। সেটা যখন মানুষ পড়বে তখন তার ভেতর জমে থাকা নিষ্ঠুরতা-হিংস্রতার জমাট সমুদ্রবরফ ভেঙে যাবে। সেখান থেকে জেগে উঠবে হৃদয়বান মানুষ, যে মানুষের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মানবিক বোধসম্পন্ন মানবজাতি আর ওপারের আমরাও।'

লেখক : কথাসাহিতি্যক, মনো চিকিৎসক।

এইচআর/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow