শহীদ হাদি স্বপ্ন দেখতেন ন্যায় ও ইনসাফের বাংলাদেশ গড়ার

সাজেদুল ইসলাম রাব্বিজুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক অনিবার্য নাম শরিফ ওসমান বিন হাদি। জন্মসূত্রে তার নাম ছিল ওসমান গনি। পরে তিনি পরিচিত হন শরিফ ওসমান হাদি নামে। বাবার নামানুসারেই তিনি এই পরিচয় বেছে নেন। একসময় কবিতা লিখতেন ‘সীমান্ত শরিফ’ নামে। ১৯৯৩ সালের ৩০ জুন ঝালকাঠি জেলার নলছিটি পৌরসভার খাসমহল এলাকায় শিক্ষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মাওলানা শরিফ আব্দুল হাদি ছিলেন নলছিটি সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক উপাধ্যক্ষ ও খাসমহল জামে মসজিদের পেশ ইমাম। মা তাসলিমা হাদি গৃহিণী। পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদরাসাই ছিল তার সাংস্কৃতিক বিকাশের মূল পাঠশালা। এখান থেকেই তিনি সংস্কৃতির নানাবিধ দিক শিখেছেন, আয়ত্ত করেছেন ও ধারণ করেছেন, যা ওসমান হাদীর ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাকে যুক্তিবাদী, স্পষ্টভাষী এবং বিতার্কিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক ও আবৃত্তিতে একাধিক পুরস্কারও অর্জন করেন। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। একই

শহীদ হাদি স্বপ্ন দেখতেন ন্যায় ও ইনসাফের বাংলাদেশ গড়ার

সাজেদুল ইসলাম রাব্বি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক অনিবার্য নাম শরিফ ওসমান বিন হাদি। জন্মসূত্রে তার নাম ছিল ওসমান গনি। পরে তিনি পরিচিত হন শরিফ ওসমান হাদি নামে। বাবার নামানুসারেই তিনি এই পরিচয় বেছে নেন। একসময় কবিতা লিখতেন ‘সীমান্ত শরিফ’ নামে। ১৯৯৩ সালের ৩০ জুন ঝালকাঠি জেলার নলছিটি পৌরসভার খাসমহল এলাকায় শিক্ষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

বাবা মাওলানা শরিফ আব্দুল হাদি ছিলেন নলছিটি সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক উপাধ্যক্ষ ও খাসমহল জামে মসজিদের পেশ ইমাম। মা তাসলিমা হাদি গৃহিণী। পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদরাসাই ছিল তার সাংস্কৃতিক বিকাশের মূল পাঠশালা। এখান থেকেই তিনি সংস্কৃতির নানাবিধ দিক শিখেছেন, আয়ত্ত করেছেন ও ধারণ করেছেন, যা ওসমান হাদীর ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাকে যুক্তিবাদী, স্পষ্টভাষী এবং বিতার্কিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক ও আবৃত্তিতে একাধিক পুরস্কারও অর্জন করেন। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন।

রাজনীতিতে আসার আগে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। একই সঙ্গে জিআরই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতায় তিনি রাজপথে নেমে পড়েন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী যখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভাগ বসানোর দিকে মনোযোগী হয়েছিল, তখন হাদি ব্যতিক্রমী চিন্তা-ভাবনায় মনোনিবেশ করেছেন। গর্ভবতী স্ত্রীকে ঘরে রেখে শহর-নগর-বন্দর ঘুরে গড়ে তোলেন ইনকিলাব মঞ্চ, যেখানে তিনি ছিলেন মুখপাত্র।

হাদির রাজনৈতিক চিন্তার মূলমন্ত্র ছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগে প্রয়োজন মানুষের চিন্তা ও সাংস্কৃতির পরিবর্তন। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিপরীতে বাঙালি মুসলমানের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্তাকে জাগিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন। এই লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার’। প্রায় শূন্য হাতে শুরু হলেও অদম্য প্রত্যয়ে এটিকে দাঁড় করান। ব্যক্তিগত জীবনের অনেক দায়িত্ব থাকার পরও, সমাজের সব বোঝা একা কাঁধে তুলে নেন। ন্যায় ও ইনসাফের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে তিনি বিপ্লবের পতাকা হাতে নেন।

ওসমান হাদি ছিলেন একজন নির্ভীক বিপ্লবী। যিনি জানতেন কখন কথা বলতে হয়, কখন চুপ থাকতে হয়। কঠিন মেজাজের হলেও যথেষ্ট বিনয়ী ছিলেন। তিনি সময়ের প্রতিটি ঘণ্টার গুরুত্ব বুঝতেন। কালচার বুঝতেন, আগ্রাসনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতেন এবং মোকাবেলার পথও চিনতেন। অনেক নেতা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে কেবল বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে দেখেন, আবার অনেকে আগ্রাসনের ভয় বোঝেন কিন্তু সাংস্কৃতির গভীরতা বোঝেন না। হাদি এই দুই জায়গাতেই অনন্য ছিলেন। কবি হিসেবে তার শব্দের জাদু, আবৃত্তির রস এবং প্রতিবাদী কবিতা জীবনের কাজের সঙ্গে মিশে একাকার হয়েছিল। বাংলাদেশে এমন দৃপ্ত কণ্ঠ এবং স্পষ্ট অবস্থানধারী বিপ্লবী খুবই বিরল।

হাদির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল নির্বাচনী প্রস্তুতি। ২০২৫ সালের শেষ দিকে তিনি ঢাকা-৮ আসনে ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করছিলেন। সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা তিনি রাজনৈতিক অংশগ্রহণকেও নিজের সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবে দেখতেন। দিনব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণায় সময় ও সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। চেয়েছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তার নেতৃত্বগুণ ও সাহসিকতাকে পুঁজি করে জাতীয় রাজনীতিতে সামগ্রিক পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে।

১২ ডিসেম্বর দুপুরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন, বক্স কালভার্ট রোড, পুরানা পল্টনে ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর রাতেই এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অবস্থা ক্রমান্বয়ে অপরিবর্তিত হলে, উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। এক সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পর ১৮ ডিসেম্বর রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই গোটা বাংলাদেশ শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। রাজপথ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে মফস্বলের চায়ের দোকান পর্যন্ত তার নাম উচ্চারিত হতে থাকে। একজন মানুষের মৃত্যুতে সারাদেশের একযোগে শোক ও স্মরণাভিব্যক্তি বিরল এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

শহীদ ওসমান হাদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে, কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের নিকটেই সমাহিত করা হয়। যেন বাংলাদেশের প্রতিবাদী চেতনার এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে উত্তরাধিকার বহন হয়। তার মৃত্যু প্রমাণ করল মানুষ মরে যায় কিন্তু আদর্শ মরে না। হাদি চলে গেছেন, কিন্তু তার স্বপ্ন বেঁচে থাকবে। তার সংগ্রাম আমাদের জন্য, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য, আমাদের সন্তানদের জন্য। প্রচারণার চরম ব্যস্ততায় তার ১০ মাসের নবজাতক সন্তান দশ ঘণ্টারও বেশি সময় বাবার কোলে আসার সুযোগ পায়নি। কিন্তু দেশ ও জনগণের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে তিনি পিছপা হননি।

পদবী আর অর্থের লোভে পড়ে কখনো নিজের আদর্শ ত্যাগ করেননি। অনল ভাষী এই কবি ও বক্তা ছিলেন রাজপথের অবিচল যোদ্ধা। ওসমান হাদি বেঁচে থাকবেন সেই অগণন মানুষের ভেতর যারা ভীরু হয়েও সাহস খোঁজে, যারা নিরক্ষর হয়েও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে চায়, যারা শিশুদের জন্য একটি ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে। তিনি আমাদের ঋণী করে দিয়ে গেছেন। তার জীবন ছিল আমাদের ভবিষ্যতের জন্য লেখা এক দীর্ঘ প্রতিবাদী কবিতা।

শহীদ ওসমান হাদির আদর্শ চিরজীবী, এদেশের মাটিতে বেঁচে থাকবে। তারুণ্যের পক্ষে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের চিহ্ন হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ কখনো তাকে ভুলবে না।

আরও পড়ুন
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, ছুটিতে রঙিন হোক শৈশব
সন্ধ্যা নামলেই পুরোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের হাট বসে যেখানে

লেখক: শিক্ষার্থী, ভোলা সরকারি কলেজ, ভোলা

কেএসকে

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow