শামুক তুলে সংসার চলে তাদের

14 hours ago 6

ভোরের আলো ফোটার আগেই জেগে ওঠেন তারা। হাতে পুরোনো বস্তা। কাঠের বৈঠা আর ছোট্ট নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তারা। নৌকায় চড়ে বগনালের বিলের গভীরে চলে যান। যেখানে কাদার নিচে লুকিয়ে আছে জীবিকার অবলম্বন জলজ শামুক। দিনভর পানিতে ডুব দিয়ে তোলেন শত শত শামুক। বস্তা ভরে গেলে নৌকা ঠেলে তীরে এনে বস্তা ফেলে রেখে আবার ফিরে যান বিলে। সন্ধ্যা নামলে সেই শামুক বিক্রি করে যে টাকা পান তাতেই সংসার চলে।

মাগুরা শালিখা উপজেলার আড়পাড়া ইউনিয়নের বরইচারা গ্রামের বাসিন্দা নিতাই সরকারেরও জীবিকা চলে শামুক সংগ্রহ করে। সামান্য কিছু জমি আছে তার, তাতে যা ফলন হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই তিনি প্রতিদিন বগনালের বিল থেকে শামুক কুড়িয়ে পাশের জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।

নিতাই সরকার বলেন, দিনে এক থেকে দেড় বস্তা শামুক কুড়িয়ে বিক্রি করলে তিনশ টাকার মতো পাই। ওই টাকাতেই ছেলে মনিগের পড়াশোনার খরচ আর সংসারের ভরণপোষণ চালাতে হয়।

শামুক তুলে সংসার চলে তাদের

শুধু নিতাই সরকার নন, একই জীবিকার সঙ্গী ষাটোর্ধ্ব কমলা রানী বিশ্বাসও। তিনি বগনাল বিল ও নরপতির খালের আশপাশে শামুক কুড়িয়ে সংসার চালান। চার মেয়ে নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার তার।

কমলা রানী বলেন, শামুক কুড়িয়ে যা পাই, তা দিয়েই খাই। মেয়েদের লেখাপড়া করাই। কখনো শাপলা বিক্রি করি, কখনো মাছ ধরি, আবার কখনো পরের বাড়িতে কাজ করি। জীবন কষ্টের, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দয়ায় এখনো বেঁচে আছি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শামুক ধরার কাজ চলে সারা বছরজুড়ে। বর্ষা হোক বা শুষ্ক মৌসুম। কাদামাটির নিচে বা পানির গভীরে লুকিয়ে থাকা শামুক হাত দিয়ে বা লাঠির সাহায্যে খুঁজে তুলে আনেন তারা। পরে সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। এক বস্তা শামুক বিক্রি হয় প্রায় তিনশ টাকায়, মৌসুম অনুযায়ী দাম ওঠানামা করে।

শামুক তুলে সংসার চলে তাদের

এ শামুক মূলত কেনেন মাছ ও হাঁসের খাদ্য ব্যবসায়ীরা। এছাড়া কিছু শামুক যায় চুন তৈরির কারখানায়, যেখানে খোলস পুড়িয়ে তৈরি হয় চুন। একসময় অকাজের বলে অবহেলিত এ জলজ প্রাণী এখন অনেক দরিদ্র পরিবারের জীবনধারণের মূল অবলম্বন।

তবে এ পেশা যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবে তা অনেক কষ্টসাধ্য। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পানিতে ভিজে থাকতে হয়। রোদ-বৃষ্টি বা ঠান্ডা, কোনো কিছু তাদের কাজ থামাতে পারে না। অনেক সময় কাদার নিচে লুকিয়ে থাকা সাপ, কেঁচো বা ধারালো লোহার টুকরোয় আহত হন তারা। কিন্তু সংসারের তাগিদে, সন্তানদের মুখের হাসির জন্য প্রতিদিন ফিরে যান সেই একই বিলে।

সরেজমিনে দেখা যায়, কেউ তালের ডোঙায়, কেউবা টিনের নৌকায় করে ছুটছেন বিলের ভেতরে। কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে একে একে কুড়িয়ে নিচ্ছেন শামুক। শামুকের মতোই তাদের জীবন নিঃশব্দ, তবু দৃঢ়। জলাশয়ের শামুক এখন শুধু নদী-খালের প্রাণ নয়, বহু দরিদ্র মানুষের জীবিকার ভরসা হয়ে উঠেছে।

শামুক তুলে সংসার চলে তাদের

স্থানীয় শামুক ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, গ্রামাঞ্চল থেকে প্রতি বস্তা শামুক ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায় ক্রয় করা হয়। পরে পরিবহন ব্যয়সহ এসব শামুক ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে প্রতি বস্তা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। সংগৃহীত শামুকগুলো একসঙ্গে পিকআপ ভ্যানে করে ঢাকায় পাঠানো হয়।

মাগুরা শালিখা উপজেলার আড়পাড়া ইউনিয়নের বরইচারা গ্রামের অনেকের শামুক বিক্রি করে উপার্জন করেন। শামুক এখন শুধু নদী-খালের প্রাণ নয়, বহু দরিদ্র পরিবারের জীবনের ভরসা। মনের অজান্তে এ ছোট জলজ প্রাণীর মধ্য দিয়ে ঘুরছে অনেকের জীবিকার চাকা।

শালিখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফেরদৌসী আক্তার বলেন, ‘শামুক প্রাকৃতিক সম্পদ। শামুকের অনেক পুষ্টিগুণ আছে। মাছের এবং হাঁসের খাদ্য হিসেবে শামুক ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতির ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শামুক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা প্রকৃতি থেকে যেন না হারিয়ে যায়, সেজন্য সরকারসহ সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিকল্প কর্মসংস্থানের কর্মসূচিও হাতে নেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

মো. মিনারুল ইসলাম জুয়েল/আরএইচ/জেআইএম

Read Entire Article