• অটোমেশন প্রক্রিয়ায় জটিলতা
• অনিবন্ধিত অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি
• ভাংতি টাকা ফেরতে সময়ক্ষেপণ
গত একবছর ধরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুর টোল প্লাজায় লেগে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট। ছুটির দিনে বিশেষ করে শুক্রবার সকালে শহর থেকে বেরোনো ও ছুটি শেষে নগরে ফেরার সময়ে দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয়। এতে নাকাল সেতু ব্যবহারকারী যাত্রীরা।
শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) শাহ আমানত সেতুর টোল প্লাজা এলাকায় সরেজমিনে চালক, যাত্রী, সেতুর টোল আদায়কারী কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বিআরটিএ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হলে যানজটের বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত হয়। এর মধ্যে তিনটি অন্যতম কারণ হলো- টোল আদায়ে অটোমেশন প্রক্রিয়ায় জটিলতা, সেতু দিয়ে অনিবন্ধিত অবৈধ যানবাহন পারাপারের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং টোল আদায়ের ক্ষেত্রে ভাংতি পরিশোধে সময়ক্ষেপণ।
শুক্রবার বেলা ১১টায় শাহ আমানত সেতুর টোল প্লাজায় দীর্ঘ যানজট দেখা যায়। এসময় শহর প্রান্ত থেকে ট্রোল ফ্রি ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার এবং মোটরসাইকেল নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছে। বিকেল ৫টার দিকে নগরীতে প্রবেশের সময় টোল প্লাজায় ছিল দীর্ঘ যানজট। টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাইকে টোল পরিশোধের ক্ষেত্রে ভাংতি দেওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছিল।
কথা হলে টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের সহ-সুপারভাইজর আরমান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের টোল আদায়ের জন্য ক্যাশলেস সুবিধার পাশাপাশি নগদে টোল আদায় করা হয়। আমাদের সিস্টেম অনুযায়ী একটি যানবাহনের টোল পরিশোধে ৫-৬ সেকেন্ড লাগার কথা। সেখানে অনেকে বড় নোট দেন, তাতে অনেক সময় ২-৩ মিনিটও লেগে যায়। বিশেষ করে ৩০ টাকার জন্য অনেকে হাজার টাকার নোট দেন। আবার ৫০ টাকার টোলের জন্য কেউ এক হাজার টাকার নোট দিলে তাকে ৯৫০ টাকা ফেরত দিতে হয়। এক্ষেত্রে টোল কালেক্টরও টাকা গুনে দেন, চালককেও গুনে ফেরত নিতে হয়। এতে ভাংতি ফেরত দিতেও সময়ক্ষেপণ হয়।’
গাড়ি ছোট হোক কিংবা বড় হোক, প্রতিটি ট্রানজেকশনে একই সময় লাগে। সরকারি ছুটির দিনে নির্ধারিত সময়ে বিশেষ করে জুমার নামাজের আগের কয়েক ঘণ্টা শহর থেকে গাড়ির চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। গাড়ির অতিরিক্ত চাপের কারণে হয়তো যানজট তৈরি হচ্ছে।- টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের অপারেশন ডিরেক্টর অপূর্ব সাহা
আমিরাবাদগামী এক বাসের চালক মো. রফিক বলেন, ‘টোল নিতে দেরি করা হয়, এতে যানজট তৈরি হচ্ছে।’ পটিয়াগামী এক বাসের হেলপার আলাউদ্দিন বলেন, ‘যত ঝামেলা টোলবক্সে। আগেও গাড়ি পার হয়েছে এ টোলবক্স দিয়ে। এখন কেন সময় বেশি লাগছে?’
পেশাগত কারণে প্রায়ই চট্টগ্রাম শহর থেকে পটিয়া যাতায়াত করতে হয় মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মুহাম্মদ ওয়াহিদ হাসানকে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দিন যত গড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত কর্ণফুলী সেতুর টোল প্লাজায় যানজট তীব্রতর হচ্ছে। ছয় মাস আগেও এ ধরনের যানজট হতো না। এখন যানবাহনের এ জটলার পেছনে অদৃশ্য কোনো কারণ দায়ী থাকতে পারে। তাছাড়া টোল প্লাজায় ইচ্ছা করে বিলম্ব করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবার টোল প্লাজায় যানজটে পড়ে অনেকে জুমার নামাজ পর্যন্ত আদায় করতে পারেনি। ছুটির দিনে শহর থেকে যাওয়ার সময় সকালে যানজটে পড়তে হয়। এ জটলা কয়েকশ মিটার পর্যন্ত হয়ে যায়। আবার শহরে প্রবেশের সময় বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত যানজটের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।’
সড়ক ও জনপথ (সওজ) চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন চৌধুরী জাগো নিউজকে, ‘টোলঅ্যাপ্রোচে দুটি ক্যামেরা সেট করা রয়েছে। একটি আরএফআইডি (রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন) রিডার আরেকটি এএনপিআর (অটোমেটিক নাম্বার প্লেট রিকগনিশন) রিডার। একটি গাড়ি টোল বুথে অ্যাপ্রোচ করলে প্রথমে আরএফআইডি ক্যামেরা গাড়িতে লাগানো আরএফআইডি স্টিকার রিড করে গাড়ির নিবন্ধন তথ্য নেয়। এক্ষেত্রে আপডেটের গাড়িগুলোর তথ্য অটোমেটিক টোল সিস্টেমে নিয়ে নেয়। সেকেন্ডের মধ্যে এই তথ্য নিতে পারে ওই ক্যামেরা। এরপর ইটিসি (ইলেক্ট্রনিক্স টোল কালেকশন) নিবন্ধন থাকলে মোবাইল ব্যাংকিং থেকে টোলের ফি কেটে নেয়। ইটিসি নিবন্ধিত না হলে নগদে টোল নেওয়া হয়।’
আরও পড়ুন
- কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুতে জট কমাতে আরও দুই টোল লেন
- চট্টগ্রামে যানজট কমানোর পদক্ষেপ চসিক-ট্রাফিক বিভাগের
- যত্রতত্র থেমে যাত্রী ওঠানো-নামানো, দেখেও দেখেন না ট্রাফিক পুলিশ
তিনি বলেন, ‘আরএফআইডি ক্যামেরা রিড করতে না পারলে সঙ্গে সঙ্গে এএনপিআর ক্যামেরা গাড়ির নাম্বার প্লেট রিড করে তথ্য নেয়। এখানেই মূলত জটিলতা। নাম্বার প্লেট রিড করার জন্য এএনপিআর ক্যামেরা নিচের দিকে সেট করা আছে। অনেক গাড়ির নাম্বার প্লেট গাড়ির ওপরে কিংবা মধ্যাংশে লাগানো থাকে। আবার অনেক নাম্বার প্লেট দুমড়েমুছড়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে এসব নাম্বার প্লেট ক্যামেরা রিড করতে পারে না।’
যানজটের জন্য অনিবন্ধিত যানবাহন অনেকাংশে দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামে যাতায়াতকারী অনেক যানবাহনের নিবন্ধন নেই। বিশেষ করে অসংখ্য সিএনজি অটোরিকশা নিবন্ধনহীন। অনেক গাড়ির নিবন্ধন থাকলেও ডকুমেন্ট হালনাগাদ নেই। ডকুমেন্ট হালনাগাদ না থাকলেও আরএফআইডি স্টিকার কিংবা নাম্বার প্লেটে গাড়ির তথ্যও পাওয়া যায় না। তখন ওই গাড়ির তথ্য বিশেষ করে গাড়ির পুরো নাম্বার টোল কালেকশন বুথে বসানো কম্পিউটারের সফটওয়্যারে ইনপুট দিতে হয়।’
শাহ আমানত সেতুর টোল প্লাজা এলাকায় এখন নিয়মিত যানজট হচ্ছে। এ যানজট নিরসনে টোল প্লাজার দুই পাশে আরও দুটি লেন নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদার কাজ করছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বুথ দুটি চালু সম্ভব হবে।- সওজ চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোসলেহ উদ্দিন চৌধুরী
অনিবন্ধিত যানবাহন সেতু দিয়ে পারাপারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেতু পাড়ি দিতে আসা গাড়ি থেকে আমাদের টোল আদায় করতে হবে। গাড়ির নিবন্ধন দেখার দায়িত্ব তো বিআরটিএর।’
টোল আদায়ে ধীরগতির বিষয়ে জানতে চাইলে টোল আদায়কারী ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সেল ভ্যান জেভির অপারেশন ডিরেক্টর অপূর্ব সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাহ আমানত সেতুতে বর্তমান সময়ে ছোট গাড়ি কিছু বেড়েছে। বিশেষ করে সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা। গাড়ি ছোট হোক কিংবা বড় হোক, প্রতিটি ট্রানজেকশনে একই সময় লাগে। সরকারি ছুটির দিনে নির্ধারিত সময়ে বিশেষ করে জুমার নামাজের আগের কয়েক ঘণ্টা শহর থেকে গাড়ির চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। গাড়ির অতিরিক্ত চাপের কারণে হয়তো যানজট তৈরি হচ্ছে।’
সেতুর টোল কালেকশন সফটওয়্যারের কিছুটা আপগ্রেডেশন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন আডগ্রেট টেকনোলজি আসছে। আগে তো টেকনোলজি ছিল না। টোলবুথে গাড়ির পুরো নাম্বারটি নেওয়া হতো না। এখন প্রত্যেক গাড়ির নাম্বার নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রথমে ক্যামেরায় লাগানো সেন্সরের মাধ্যমে নেওয়া হয়। সেন্সর না নিতে পারলে কম্পিউটারে ম্যানুয়াল ডাটা ইনপুট দেওয়া হয়। যেসব গাড়ির ডকুমেন্ট আপডেট আছে, নাম্বার প্লেট সুন্দর, ভাঙাচোরা নেই, সেসব গাড়ি আমাদের ক্যামেরাগুলো দ্রুত রিড করতে পারে। আমরা যে এনপিআর টেকনোলজি ব্যবহার করছি, সেটি লালখান বাজার-বিমানবন্দর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায়েও ব্যবহার করা হচ্ছে।’
বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক আইনুল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিআরটিএ থেকে নিবন্ধিত ট্রাক, বাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল প্রত্যেকটি গাড়িতে আরএফআইডি স্টিকার লাগানো আছে। নিবন্ধন পরবর্তী বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টারি (বিএমটিএফ) আরএফআইডি স্টিকারগুলো গাড়িতে লাগানোর কাজ করে। গাড়ির সামনে ওপরের দিকে স্টিকার লাগানো থাকে। আবার নাম্বার প্লেটও রয়েছে। টোলে যে টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়, তাতে আরএফআইডি কিংবা নাম্বার প্লেট রিড করতে না পারার কোনো কারণ নেই।’
তিনি বলেন, ‘দেশের পদ্মা সেতু, যমুনা, মেঘনা সেতুসহ বড় সেতুগুলোতে টেকনোলজি ব্যবহার করে টোল আদায় করা হচ্ছে। ওইসব স্থান থেকে কোনো সমস্যার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ধরনের সমস্যা হলে তো সড়ক ও জনপথ বিভাগ বিআরটিএকে লিখিত জানাতে পারে। কিন্তু শাহ আমানত সেতুর টোল আদায়ের এ জটিলতার কথা তো আমাদের জানানো হয়নি।’
নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন দুই টোল লেন
চট্টগ্রামে শাহ আমানত সেতুতে (তৃতীয় কর্ণফুলী) জট কমাতে আরও দুটি টোল লেন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। ইতোমধ্যে মইজ্জ্যারটেক এলাকা থেকে টোল সড়ক বর্ধিতকরণের কাজ শুরু করেছে সওজ। নতুন দুটি টোল লেন হলে ১০টিতে দাঁড়াবে টোল বুথ। বর্তমানে আসা-যাওয়ায় চারটি করে মোট আটটি বুথে টোল আদায় করা হয়। নতুন টোল লেন দুটি নির্মাণ শেষে ব্যবহার শুরু হলে টোল প্লাজা যানজটমুক্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীরা।
জানা যায়, ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শাহ আমানত সেতু চালু হয়। প্রথমে টোল প্লাজায় তিনটি করে উভয় দিকে ছয়টি লেন নিয়ে সেতুর টোল আদায় কার্যক্রম চালু হয়। সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ অত্যধিক হওয়ার কারণে তিন বছর আগে টোল প্লাজার দুই পাশের অযান্ত্রিক যান চলাচলের জন্য রাখা ফ্রি টোল লেন দুটির পরিসর বাড়িয়ে ছোট যানবাহন চলাচলের উপযোগী করে টোল বুথ করা হয়। এরপর থেকে দুপাশে চারটি করে আটটি টোল বুথ রয়েছে। তারপরও প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কারণে যাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
সওজ চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোসলেহ উদ্দিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাহ আমানত সেতুর টোল প্লাজা এলাকায় এখন নিয়মিত যানজট হচ্ছে। এ যানজট নিরসনে টোল প্লাজার দুই পাশে আরও দুটি লেন নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদার কাজ করছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বুথ দুটি চালু সম্ভব হবে।’
এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএস