শিক্ষকতায় অধিক যোগ্যদের আকৃষ্ট করা অত্যাবশ্যক

2 hours ago 5

গত ১৯ আগস্ট ২০২৫ তারিখে এনটিআরসিএ কর্তৃক প্রকাশিত ফলাফল অনুসারে দেখা যায়, ‘ষষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তিতে ৪১ হাজার ৬২৭ জন প্রার্থীকে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ শিক্ষক পদে যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, তাতে শূন্য পদ ছিল এক লাখ ৪২টি। সেই হিসাবে ৫৮ হাজার ৪১৫টি পদ শূন্য থেকে গেলো। এতে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে যে শিক্ষক সংকটে ভুগছে, তার যথাযথ সমাধান হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানই নতুন শিক্ষক পাবে না।

যেহেতু জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সুপারিশের বাইরে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ নেই, ফলে শিক্ষক সংকটে বাধাগ্রস্ত হবে শিক্ষা কার্যক্রম। এনটিআরসিএ জাগো নিউজকে জানিয়েছে, যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় তারা পদগুলো শূন্য রাখতে বাধ্য হয়েছে। যতগুলো শূন্য পদে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল আবেদন পড়েছে তার প্রায় অর্ধেক!’ পর্যাপ্ত যোগ্য প্রার্থী না থাকায় পূর্বেও শূন্য ছিল বিপুল সংখ্যক শিক্ষক পদ। সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে, শিক্ষক পদে কাঙ্ক্ষিত আবেদন পাওয়া যাচ্ছে না কেন, নিয়োগের জন্য যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

এ প্রশ্নের উত্তর যতভাবেই আমরা ঘুরিয়ে দেই না কেন শেষ কথা হচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এতই কম যে, যারা অন্য কোন চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন তারা শিক্ষক হতে আসছেন না। বাধ্য হয়ে কেউ শিক্ষকতায় এলেও থাকতে চাচ্ছেন না। থাকলেও শিক্ষকতাকে একমাত্র পেশা হিসেবে জীবন ধারণ করতে পারছেন না। তাই মনেপ্রাণে শিক্ষক হয়ে উঠতে পারছেন না।

এসব বিবেচনায় তুলনামূলক কম যোগ্যরা বেসরকারি শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করছেন ও হচ্ছেন। অথচ আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৯৫% শিক্ষার্থীর পাঠদানে নিয়োজিত বেসরকারি শিক্ষক। বড়ই উদ্ভূত আমাদের প্রত্যাশা! তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক দিয়ে আমরা তৈরি করতে চাই অধিক যোগ্য নাগরিক-কর্মী। এটি কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। শিক্ষক যদি মানুষ গড়ার কারিগর হয় তো একজন অযোগ্য বা কম যোগ্য শিক্ষক সারা জীবনে তৈরি করবেন অগণিত অযোগ্য বা কম যোগ্য মানুষ এটিই স্বাভাবিক, এটিই সত্য। অথচ এই কঠিন বাস্তবতা অনুধাবন করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই ব্যর্থ!

একজন ভালো শিক্ষক আজীবন লালন করেন জানার এবং জানানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা। জ্ঞানার্জনে হন নিরলস। অত্যন্ত সমৃদ্ধ হন নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে। শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অত্যন্ত ভালোভাবে জানেন শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও শিক্ষাদানের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে হন সমৃদ্ধ। জানেন আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, সুফল-কুফল এবং সে আলোকে শিক্ষার্থীকে দেন সঠিক দিকনির্দেশনা। শিক্ষালাভে সদাসর্বদা থাকেন সক্রিয়। হন বই ও প্রকৃতির একনিষ্ঠ পাঠক এবং সেভাবেই গড়ে তুলেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক নিজে হন সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী। কেননা, শিক্ষাদান শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য।

শিক্ষাগ্রহণ শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত ভালো ছাত্রদেরই ভালো শিক্ষক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যে ব্যক্তি শিক্ষাজীবনে পড়ুয়া থাকে, পরিশ্রমী থাকে, মেধাবী থাকে, নম্রভদ্র থাকে, ধৈর্যশীল থাকে, ক্লাসে উপস্থিত থাকে, পরীক্ষায় এগিয়ে থাকে, সহশিক্ষায় আগ্রহী থাকে, ভালো কাজে উদ্যমী থাকে; সে স্বেচ্ছায় শিক্ষক হলে ভালো শিক্ষক হয়ে উঠবার সম্ভাবনা যতটা বেশি থাকে, এর বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কেউ শিক্ষক হলে ভালো শিক্ষক হয়ে উঠবার সম্ভাবনা ততটাই কম থাকে। শিক্ষক যত বেশি জ্ঞানী-গুণী থাকেন, শিক্ষার্থীদের তত বেশি জ্ঞানী-গুণী হওয়ার সুযোগ-সম্ভাবনা থাকে।

তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কেননা, শিক্ষক অযোগ্য হলে জাতি অযোগ্য হয়। আমাদের সর্বাধিক মেধাবী ও যোগ্য সন্তানরা যেদিন সাগ্রহে এসে দখল করবে আমাদের স্থান সেদিনই নিশ্চিত হতে পারে আমাদের শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত মান। শিক্ষকতায় যোগ্যতা কমিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে নয়, বেতন বাড়িয়ে অধিক যোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষার প্রকৃত মান, নিশ্চিত করতে হবে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি।

যতই আধুনিক শিক্ষা উপকরণ যুক্ত করা হোক, উন্নত সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক; শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা খুবই কঠিন কাজ বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসেননি, আসছেন না যুগ যুগ ধরে। টাকা হলে রাতারাতি শিক্ষা উপকরণ বদল করা যায়, পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা যায়; কিন্তু শিক্ষকদের বদল বা মান বৃদ্ধি করা যায় না।

শিক্ষকের মান বৃদ্ধি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। শিক্ষকের বেতন সর্বোচ্চ নির্ধারণ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সব শিক্ষকের মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যাবে এমনটি অবাস্তব। কেননা, এই আমি যতদিন আছি ততদিন দিয়েই যাব ফাঁকি, রেখেই যাব কম দক্ষতার স্বাক্ষর। তথাপি বৃদ্ধি করতে হবে আমার তথা শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা। শিক্ষকতায় আনতে হবে সর্বোচ্চ মেধাবীদের, জ্ঞানীদের, গুণীদের।

বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও যখন যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না তখন শূন্য পদ পূরণের তাৎক্ষণিক কৌশল যদি এমন হয় যে কম যোগ্যদেরই নিয়োগ দেওয়া হবে তো সেটি নিশ্চয়ই কম মঙ্গলজনক হবে। কেননা, বর্তমানে শিক্ষকতায় যাদের আবেদন পাওয়া যায় তাদের অধিকাংশই অন্য পেশা/চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়ে আসেন। অন্য পেশার তুলনায় কম যোগ্য শিক্ষক বারবার নিয়োগ দিতে হলে, এদের সংখ্যা লাখ লাখ হলে, দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। একজন কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের কুফল ২৫-৩০ বৎসর অর্থাৎ তিনি যতদিন কর্মরত থাকেন ততদিন দীর্ঘায়িত হয়। এ কুফল বিস্তৃত হয় দেশ ও সমাজের সর্বত্র। তথাপি আমরা বৃদ্ধি করতে চাই না বেসরকারি শিক্ষকদের মান।

অনেকেই মনে করি, বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা সবচেয়ে কম থাকবে, বেসরকারি শিক্ষকগণ তুলনামূলক কম যোগ্য থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কেননা, তারা তো বেসরকারি। কিন্তু আমরা এটি ভাবি না যে, এ বেসরকারি শিক্ষকগণই কোন না কোন পর্যায়ে পাঠদান করেন দেশের প্রায় সকল শিক্ষার্থীদের এবং ওই শিক্ষার্থীরাই নিয়োজিত হয় দেশের সকল কর্ম ক্ষেত্রে। এরাই নেতা হয়, কর্মী হয়, আমলা হয়, মন্ত্রী হয়, দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত হয়।

যুগ যুগ ধরে আমরা অনুভব করতে পারিনি/করিনি উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করে অধিক যোগ্য নাগরিক-কর্মী তৈরির জন্য অধিক যোগ্য শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা। তাই আমরা বৃদ্ধি করিনি শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান, নিশ্চিত করিনি অধিক যোগ্যদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার সঠিক ও কার্যকর ব্যবস্থা। বরং এক্ষেত্রে আমরা করেছি উল্টো কর্মকাণ্ড! অন্যান্য পেশার তুলনায় কমিয়েছি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা।

এখনো একটি তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি গ্রহণযোগ্য শিক্ষকতায়। ছাড় দিয়েছি শিক্ষকতায় প্রবেশের বয়সে। এখনো ৩৫ বছর বয়সে আবেদন করা যায় শিক্ষকতায় প্রবেশের জন্য; যা অন্য অনেক পেশায় সম্ভব নয়। বিসিএসসহ অন্যান্য অনেক নিয়োগ পরীক্ষার তুলনায় সহজ করা হয় শিক্ষক নিয়োগের বাছাই পরীক্ষা। এক কথায় সবই করা হয় তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষকতায় আনার জন্য। তথাপি বৃদ্ধি করা হয় না শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, নিশ্চিত করা হয় না অতি আগ্রহে অধিক যোগ্যদের শিক্ষকতায় আগমন ও আত্মনিবেদন। তাই পাওয়া যায় না যোগ্য শিক্ষক, শূন্য থাকে শিক্ষকতার পদ। প্রাপ্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় আমাদের সন্তানেরা।

কোনো রকম কোটা সংরক্ষণ করে, যোগ্যতা কম নির্ধারণ করে, বয়স বেশি নির্ধারণ করে, বাছাই প্রক্রিয়া শিথিল করে, তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কেননা, শিক্ষক অযোগ্য হলে জাতি অযোগ্য হয়। আমাদের সর্বাধিক মেধাবী ও যোগ্য সন্তানরা যেদিন সাগ্রহে এসে দখল করবে আমাদের স্থান সেদিনই নিশ্চিত হতে পারে আমাদের শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত মান। শিক্ষকতায় যোগ্যতা কমিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে নয়, বেতন বাড়িয়ে অধিক যোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষার প্রকৃত মান, নিশ্চিত করতে হবে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি।

লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article