পাঠ্যক্রম, শিক্ষানীতি, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, উচ্চশিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, দক্ষতা, মূল্যায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ ৩০ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
বৃহস্পতিবার ( ১৪ আগস্ট) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এসব প্রস্তাবনা পেশ করেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রম করে আমরা দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছি। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে ফ্যাসিবাদী সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ, কল্যাণমুখী ও সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পুনর্গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বা ঘোষণা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি বরাবরের মতোই উপেক্ষিত হচ্ছে, যা হতাশাজনক।
শিক্ষা সংস্কারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা পেশ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ঔপনিবেশিক মনোভাব, পাশ্চাত্য সভ্যতার আগ্রাসন এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের প্রভাব এ দেশের নিজস্ব শিক্ষা কাঠামো তৈরিতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে ড. কুদরত- ই -খুদা শিক্ষা কমিশন স্বাধীনতার মূলমন্ত্র (সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার) উপেক্ষা করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যা ছিল দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা-চেতনা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক জীবনবোধের পরিপন্থি। এরপর ১৯৭৮ সালের শিক্ষা উপদেষ্টা পরিষদ, ১৯৮৩ সালের শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি, ১৯৮৭ সালের জাতীয় শিক্ষা কমিশন-১১, ১৯৯৪ সালের কারিকুলাম টাস্কফোর্স, ২০০১ সালের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ কমিটি শিক্ষা সংস্কারে কাজ করেছে বটে; কিন্তু তাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ ও সুবিধা রক্ষায় বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করা হয়েছে।
শিবির সভাপতি বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার ২০১০ সালে একটি একপাক্ষিক ও দুরভিসন্ধিমূলক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যার পূর্ণ বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০২২ সালে। উক্ত শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার মূলোৎপাটন করার নীল নকশা গৃহীত হয়। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তারা ইসলামি শিক্ষাকে বিকৃত করে শিরক ও বিদআতের মতো ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোকে পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করে।
আরও পড়ুন:
- ছাত্রলীগের মতো শিবিরও গুপ্ত রাজনীতির মাধ্যমে হল দখল করছে
- ১৫১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করছে এনসিপি, নাম প্রকাশ শিগগির
জাহিদুল ইসলাম বলেন, ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী একটি দেশের শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত জিডিপির নূন্যতম ৬ শতাংশ; কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার ২ শতাংশেরও কম। এশিয়ার অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে আমাদের শিক্ষা খাতের করুণ অবস্থা আরও ন্যাক্কারজনকভাবে ফুটে ওঠে। সিঙ্গাপুরে শিক্ষাখাতের ব্যয় জাতীয় বাজেটের প্রায় ১০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১৭–২০ শতাংশ, ভারতে সরকারি ব্যয়ের ১৩–১৭ শতাংশ (জাতীয় বাজেটে প্রায় ২.৫ শতাংশ), এবং চীন ১০–১৩ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ২০২৫–২৬ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ মাত্র জাতীয় বাজেটের মাত্র ১.৮–২ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিচারে অতি নগণ্য।
৩০ দফা প্রস্তাবনা
১: অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কমিশন গঠন
২: জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণ
৩: ইসলামী মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সমন্বয়ে আধুনিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন
৪: বহুমাত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ
৫: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষায় (STEM) অগ্রাধিকার প্রদান
৬: ভাষা শিক্ষা সংক্রান্ত
৭: সামরিক ও শারীরিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ
৮: শিক্ষা বাজেট অগ্রাধিকার
৯: শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক স্কুলিং পদক্ষেপ
১০: উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন
১১: স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন গঠন
১২: নারী শিক্ষার প্রসারে উপর্যুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ
১৩: শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
১৪: শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসন নিশ্চিত ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিকীকরণ
১৫: মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ
১৬: শিক্ষার্থী বান্ধব শিক্ষাঙ্গন বাস্তবায়ন
১৭: যোগ্য ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ গঠন
১৮: গবেষণামুখী উচ্চশিক্ষা
১৯: মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত
২০: কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধি
২১: মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার
২২: শিক্ষক প্রশিক্ষণ কাঠামোর আধুনিকায়ন
২৩: শিক্ষক মূল্যায়নের কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তন
২৪: চাকরিতে সমান সুযোগ ও ন্যায়ভিত্তিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ
২৫: ছাত্ররাজনীতির যথাযথ চর্চা ও নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন আয়োজন
২৬: বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ
২৭: পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মূলধারার শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তকরণ
২৮: কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব হ্রাস
২৯: উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়ন ও সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ
৩০: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবক-অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ
আরএএস/এনএইচআর/এমএস