গাইবান্ধা শহরের ভিউইড সড়কের পাশে অবস্থিত কে এন রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৬৩ বছর বয়সী বিদ্যালয়টির আশপাশে ব্যাপক ঘনবসতি। সেই হিসেবে শ্রেণিকক্ষগুলো শিক্ষার্থীতে ভরপুর থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, শ্রেণিকক্ষগুলোতে চার-পাঁচ জন করে শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে শ্রেণিকার্যক্রম। শিশুশ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে মোট ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে বলে জানান শিক্ষকরা। এর মধ্যে নিয়মিত শিক্ষার্থী আরও কম। শিক্ষার্থী সংকটের এ চিত্র দেখা গেছে অন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুতেও। তবে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে (কিন্ডার গার্টেন) দেখা গেছে শিক্ষার্থীতে ঠাসা।
প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, গাইবান্ধা পৌর শহরে ১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে ৩৭০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে। তবে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৫০০। এর মধ্যে ছয়টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা সন্তোষজনক হলেও বাকিগুলোতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ শিক্ষার্থী নেই। তবে শিক্ষার্থী সংকট থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে। ব্যক্তি মালিকানাধীন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শাহ্ আহম্মেদ উদ্দিন শিশু নিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২১০০, জিইউকে রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ শিশু শ্রেশি হতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৪০০ ও এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিশু শ্রেণি হতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৫২৬ জনের শিক্ষার্থী রয়েছে।
আরও পড়ুন:
- খানাখন্দে ভরা মহাসড়কে গাড়ি চলে হেলেদুলে
- দুই টাকার হোটেলে তৃপ্তির খাওয়া, মেন্যুতে থাকে গরুর মাংস-মাছ-ডাল
বেসরকারি স্কুল সংশ্লিষ্টরা জানান, পৌর এলাকায় অন্তত ১২টি বেসরকারি বিদ্যালয় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। প্রাথমিকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় প্রায় তিনগুণ শিক্ষার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে।
কে এন রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়টিতে মোট ৪০ শিক্ষার্থী ক্লাস করছেন। এর মধ্যে শিশু শ্রেণিতে ১১ জন, প্রথম শ্রেণিতে ৭ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৫ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৪ জন ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৫ জন অধ্যয়ন করছে। ছাত্র-ছাত্রী না থাকলেও বিদ্যালয়টিতে শিক্ষকের কোনো অভাব নেই। স্কুলটিতে ছয়জন শিক্ষক-দুজন কর্মচারী রয়েছেন। শিক্ষার্থীশূন্য হওয়ার পথে থাকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে নারাজ।
তাদের ভাষ্য, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস স্কুলটির বিষয়ে অবগত। এখানে শিক্ষকদের কিছুই করার নেই।
‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান অনেকটাই খারাপ। ওখানে শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নিতে চান না। এক কথায় সবদিক থেকেই গুরুত্ব না থাকায় আমার মতো অনেক অবিভাকই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়ানোর চেষ্টা করেন।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট অবকাঠামো রয়েছে। একটি অফিস কক্ষ ও ৬টি শ্রেণিকক্ষসহ মোট সাতটি কক্ষ রয়েছে। এরপরও দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি শিক্ষার্থীদের একই রুমে পাশাপাশি বসিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন দুজন নারী শিক্ষক। শিক্ষক অনিম বেগম দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন এবং রাজিয়া সুলতানা ক্লাস নিচ্ছেন তৃতীয় শ্রেণির ইংরেজি বিষয়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষকরা বলেন, ক্লাসে শিক্ষার্থী একেবারে কম, তাই দুজন মিলে পাশাপাশি ক্লাস নিচ্ছি।
ওই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিউল আলীমের মা সাবিনা বেগম বলেন, ‘ছোলক স্কুলে নিয়ে আসে বারান্দায় দাড়ে আছি। ট্যাকা পয়সা থাকলে তো ভালো স্কুলোত ভর্তি করা লাম হয়।’
আরও পড়ুন:
- চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সুইমিংপুল ৭ বছর বন্ধ
- ‘বাবা উঠো, মজা আইন্না দাও’ কবরের কাছে গিয়ে বলে ছোট্ট সাজিদুল
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৬৩ বছরেও স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল দেখাতে পারেনি বিদ্যালয়টি। অথচ শিক্ষকরা তাদের কর্তাব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করে মাসিক ভুয়া প্রতিবেদন দাখিল করে বহাল তবিয়তে চাকরি করে আসছেন।
স্থানীয় হুমায়ুন সরকার বলেন, অনিয়মের পাশাপাশি এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ না থাকায় কেউ এখানে ভর্তি হয় না। পড়ালেখার পরিবেশ নেই, শুধু ফাঁকিবাজি চলে। জেনেও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা সব হজম করে পকেট ভরছেন আর ভালো রিপোর্ট দিচ্ছেন।
জানা যায়, সম্প্রতি স্কুলের পড়ালেখার পরিবেশ তৈরি করতে ৬ জন শিক্ষিকা ছাড়াও একজন দপ্তরি নিয়োগ করা হয়। নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষিকারা শিশুদের শিক্ষার মান উন্নয়নের চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা শিক্ষার্থী পেতে বাড়ি বাড়ি ঘুরেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি। বরং শিক্ষার্থী না পেয়ে তারাও হতাশ।
‘শিক্ষার্থী না পাওয়া এটা আমাদের শিক্ষকদের ব্যর্থতা। কারণ অনেক অবিভাবককে আমরা বার্তা দিতে পারিনি যে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে ভালো রেজাল্ট করা যায়। আমাদের প্রতি অবিভাবকদের অনীহা আসার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছি।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছা. ওয়াহিদা শিরিন বলেন, প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই অবগত আছে। শিক্ষার্থী বাড়ানোর জন্য সবাই চেষ্টা করছি। দুইজন শিক্ষক একই কক্ষে ক্লাসের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
শুধু কে এন রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয় শহরের প্রাণকেন্দ্র গোরস্তান রোডের আসাদুজ্জামান এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একই দশা। পর্যাপ্ত শিক্ষক থাকলেও তেমন শিক্ষার্থী নেই। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়টির মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৪০।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নুরে এলা নাজমা শাকিল নিজের কাঁধে দায় স্বীকার করে বলেন, শিক্ষার্থী না পাওয়া এটা আমাদের শিক্ষকদের ব্যর্থতা। কারণ অনেক অবিভাবককে আমরা বার্তা দিতে পারিনি যে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে ভালো রেজাল্ট করা যায়। আমাদের প্রতি অবিভাবকদের অনীহা আসার কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছি।
এছাড়া পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি থাকলেও নিয়মিত ক্লাস করছে ১৬০ জনের মতো। উত্তর পাড়া ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার্থী ভর্তি ১৬০ জন। নিয়মিত ক্লাস করে ১২০ জন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সন্তানকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পরিবর্তে অভিভাবকরা কিন্ডারগার্টেনে ঝুঁকছেন। এছাড়া শহরে এনজিও দ্বারা প্রচলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্তানদের ভর্তি করছেন অভিভাবকরা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানের প্রতি ভরসা না পেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করাচ্ছেন অনেকে। এতে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না।
‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী আনতে হলে শিক্ষকদের নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। ব্যক্তিমালিকাহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে রেজাল্ট ভালো করতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।’
অভিভাবক ইসমাইল হোসেন বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান অনেকটাই খারাপ। ওখানে শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নিতে চান না। এক কথায় সবদিক থেকেই গুরুত্ব না থাকায় আমার মতো অনেক অভিভাবকই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়ানোর চেষ্টা করেন।
পলাশবাড়ী আদর্শ কলেজের অধ্যাপক ফেরদৌস আলম বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী আনতে হলে শিক্ষকদের নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে রেজাল্ট ভালো করতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়ে অযথা সময় কাটানো বন্ধ করতে হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধান স্কুলে উপস্থিত না থাকার কারণে অন্য শিক্ষকরা অনেক সময় ক্লাস নেন না। এসব বিষয় অনেকটা সচেতন অবিভাবকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার কারণে তারা তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করাতে চান না।
গাইবান্ধা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লক্ষণ কুমার বলেন, জেলা শহরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংকট রয়েছে। যেসব স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম আমরা সেসব স্কুলে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করছি।
এমএন/এমএস