শিল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে হবে

1 month ago 9

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একাধিক ফ্রন্টে চরম চাপের মুখে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দার মুখে, শিল্পকারখানা টিকে থাকার লড়াইয়ে, এবং কর্মসংস্থান আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। উৎপাদন ব্যয়ের লাগামহীন বৃদ্ধি, ডলারের উচ্চমূল্য, জ্বালানি খাতে অস্থিরতা এবং ঋণের চড়া সুদে দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশে নেমে এসেছে সংকটের ঘন ছায়া।

শিল্পের উৎপাদনের সাথে দেশের গরিব-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের স্বার্থ জড়িত। এই স্বার্থ হচ্ছে বাঁচা মরার লড়াই। একটা দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি শিল্প উৎপাদন। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমার অর্থ হলো শিল্প খাতের গথি শ্লথ বর্তমানে। তাছাড়া শ্লথগতির কারণে যে অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান এরই মধ্যে কমে গেছে সেটি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। ২০১৩ সালে অর্থনীতিতে শিল্প বা উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। কিন্তু ২০২৪ সালে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশে। শিল্প বা উৎপাদন খাতে এ ধরনের পতন দেশের অর্থনীতির জন্য এমনিতেও উদ্বেগজনক।

কারণ উৎপাদন খাতই সাধারণত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও রফতানি প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমন পরিস্থিতিতে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি বা ঋণপত্র খোলার পরিমাণ কমে যাওয়া স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে না। সেই সঙ্গে এটি দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতির চিত্রও প্রতিফলিত করছে।

যেকোনো শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। দেশের শিল্প খাতের জন্য মূলধনি যন্ত্রের যে চাহিদা তার বেশির ভাগই পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। দেশে আমদানি হওয়া ক্যাপিটাল মেশিনারি বা মূলধনি যন্ত্রের উল্লেখযোগ্য খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল, লেদার বা ট্যানারি, জুট, গার্মেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যাল ও প্যাকিং। যন্ত্রপাতি আমদানি করেই উদ্যোক্তারা নতুন কারখানা স্থাপন করেন। এতে কর্মসংস্থানের বিকাশও ঘটে।

কিন্তু দুঃখজনক হলো, টানা তিন বছরের অধিক সময় ধরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে। এমনকি যন্ত্রের ঋণপত্র খোলাও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) মূলধনি যন্ত্রের আমদানি কমেছে ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ। আর এ অর্থবছরের ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) পরিসংখ্যান বলছে, মূলধনি যন্ত্র আমদানির লক্ষ্যে ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। শিল্প খাতে এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। সব মিলিয়ে শিল্প খাতের আকাশে অমানিশার অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছে, কিন্তু তেমন সুফল দেখা যাচ্ছে না।

পাশাপাশি ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বলা বাহুল্য, মূলধনি যন্ত্র আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা ও আমদানিতে যে নেতিবাচক প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক নয়। বিশেষত যদি এ নেতিবাচক ধারা দীর্ঘায়িত হয়।

দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের বড় অংশই বেসরকারি খাতনির্ভর। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি সেভাবে হয়নি। আবার দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট ও গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়ানো হলে বেসরকারি ঋণের প্রবাহ কমতে থাকে।

মব সন্ত্রাস বন্ধ করা না গেলে কেউ দেশে ব্যবসা করতে চাইবে না, বিনিয়োগে আগ্রহ পাবে না। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে। এছাড়া মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে সময়োপযোগী নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এলসি নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া সহজ ও বেগবান করতে উদ্যোগী হতে হবে।

স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি সুদের কারণে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ গ্রহণে নিরুৎসাহিত বোধ করেছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও ঋণপ্রবাহ কমার কারণেও দেশে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি কমেছে। আর সব মিলিয়ে দেশে নতুন শিল্প স্থাপন বা কর্মসংস্থান বিকাশের পথ সংকুচিত হয়ে আসছে। সেই সঙ্গে কর্মজীবীদের অনেকে চাকরিচ্যুতও হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিগত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের শ্রমশক্তির ৪ শতাংশ চাকরি হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মূলধনি যন্ত্র আমদানির পেছনে বিদ্যমান সংকটগুলোর সমাধান আবশ্যক, যাতে অর্থনীতি গতিশীল রাখা যায়।

শিল্প উৎপাদনের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কবল থেকে বেসরকারি খাতকে বের করতে হবে। সুদহার না কমলে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে আগ্রহী হবেন না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যেখানে ব্যবসার খরচ বেড়েছে, সেখানে বাড়তি সুদের হার ব্যবসায়ীদের আরো আর্থিক চাপে ফেলেছে। সুদহার নমনীয় করার পাশাপাশি বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা দূর করাও জরুরি। বর্তমানে উদ্যোক্তাদের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তার প্রধান কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান পদক্ষেপের ঘাটতি।

এ দুই সমস্যা সমাধানের জন্য নীতি সহায়তা ও নীতি ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। আমাদের দেশের সমস্যা হলো, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নীতিরও বদল হয়ে যায়। বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে বিনিয়োগকারীরা সমস্যায় পড়েন। সরকার পরিবর্তনে বিনিয়োগে যাতে কোনো প্রভাব না পড়ে সেজন্য রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে অভিন্ন নীতি প্রণয়ন জরুরি। সরকারকে এক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা সঞ্চার করা দরকার।

সামাজিক অস্থিরতাও বর্তমানে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনাস্থার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে, যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন, মব সন্ত্রাস, গণপিটুনির ঘটনা, অপহরণ, মাদক ব্যবসা ও নানা ধরনের অপরাধ নিয়মিতভাবে সংঘটিত হচ্ছে, যা দেশের স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে খুন হয়েছেন ১ হাজার ৯৩০ জন। সম্প্রতি রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্য জনসমক্ষে একজন ভাঙারি পণ্য ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে ও পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়েছে। কারণ ওই ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এ ঘটনা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক দশা আরো একবার প্রকাশ্যে এনেছে। এমন আরো অনেক ব্যবসায়ী হত্যার শিকার হয়েছে বিগত সময়গুলো।

এ ধরনের মব সন্ত্রাস বন্ধ করা না গেলে কেউ দেশে ব্যবসা করতে চাইবে না, বিনিয়োগে আগ্রহ পাবে না। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে। এছাড়া মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে সময়োপযোগী নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এলসি নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া সহজ ও বেগবান করতে উদ্যোগী হতে হবে।

শিল্প উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি কমতে থাকা অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো দিক নয়। কেননা কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ জিডিপিতে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমে গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা মোটেও কাম্য নয়।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article