শিল্পখাতে জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের শিল্পখাতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি উৎপাদন, বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। শনিবার (২৯ নভেম্বর) ডিসিসিআই মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের শিল্পখাতে জ্বালানি সক্ষমতা নীতিমালা, টেকসই উন্নয়নের পথ-নির্দেশনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, আমাদের জিডিপিতে শিল্পখাত ৩৫ শতাংশের বেশি অবদান রাখে। তবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশের মোট গ্যাসের ১৯ শতাংশের ব্যবহারকারী এই বিশাল খাতটি বর্তমানে এক গভীর অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয়ে দাড়িঁয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৩-২৪ সালে গ্যাসের দাম রেকর্ড ১৭৮ শতাংশ বাড়ানোর পর, সম্প্রতি শিল্পখাতে আরও ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর ফলে টেক্সটাইল, স্টিল ও সারের মতো সেক্টরগুলোর উৎপাদন ৩০-৫০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে এসএমই খাতের কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় শিল্পখাতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জ্বালানির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা কেবল নীতিগত অগ্রা

শিল্পখাতে জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের শিল্পখাতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি উৎপাদন, বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।

শনিবার (২৯ নভেম্বর) ডিসিসিআই মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের শিল্পখাতে জ্বালানি সক্ষমতা নীতিমালা, টেকসই উন্নয়নের পথ-নির্দেশনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।

ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, আমাদের জিডিপিতে শিল্পখাত ৩৫ শতাংশের বেশি অবদান রাখে। তবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশের মোট গ্যাসের ১৯ শতাংশের ব্যবহারকারী এই বিশাল খাতটি বর্তমানে এক গভীর অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয়ে দাড়িঁয়েছে।

তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৩-২৪ সালে গ্যাসের দাম রেকর্ড ১৭৮ শতাংশ বাড়ানোর পর, সম্প্রতি শিল্পখাতে আরও ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর ফলে টেক্সটাইল, স্টিল ও সারের মতো সেক্টরগুলোর উৎপাদন ৩০-৫০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে এসএমই খাতের কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় শিল্পখাতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জ্বালানির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা কেবল নীতিগত অগ্রাধিকারই নয়, বরং টেকসই শিল্পায়নের পূর্বশর্ত।

দেশের শিল্প ও অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার সম্প্রসারণ এবং টেকসই জ্বালানি কাঠামো গঠন ও অপচয় রোধের উপর জোরারোপ করেন তাসকীন আহমেদ।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ২০৩০ সালের পর দেশীয় গ্যাসের মজুদ কমার বিষয়টি বলা হলেও অফশোর-অনশোরে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে তেমন উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি, তাই আমরা নিজস্ব উৎপাদিত গ্যাস ব্যবহার করতে পারছি না। আমাদের আমদানিনির্ভর গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, জ্বালানি খাতে সরকার ক্রামগত ভর্তুকি দিচ্ছে। কারণ, এর সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।

তিনি জানান, জ্বালানি খাতে বর্তমানে দক্ষতার হার ৩০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। এ দক্ষতা আরও বাড়নো সম্ভব হলে বিশেষ করে বিদ্যুৎ ঘাটতি কমবে। এছাড়া, দেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিলে এ অবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান এ অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে মাষ্টারপ্ল্যান থাকলেও সহায়ক নীতিমালার অনুপস্থিতির বিষয়টি শিল্পখাতকে বেশ ভোগাচ্ছে। তিনি জানান, শিল্পে জ্বালানি সক্ষমতার বিষয়ে যেমন সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই, তেমনিভাবে সব শিল্পখাতে জ্বালানি সক্ষমতার প্রণোদনা প্রাপ্তিতেও বৈসাদৃশ্য রয়েছে।

তিনি জানান, ঢাকা চেম্বার ও সানেম যৌথভাবে পরিচালিত ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় তৈরি পোষাক, সিমেন্ট, স্টিল ও বাণিজ্যিক খাতের শিল্প উদ্যোক্তা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়া হয়েছে, যেখানে জ্বালানি দক্ষতা বিষয়ে সচেতনতা, জ্বালানি নিরীক্ষা, জ্বালানি সাশ্রয়, অর্থায়ন ও প্রণোদনা, গ্রিড আধুনিকায়ন, বাস্তবায়ন ও যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। যেখানে অংশগ্রহণকারীরা এনার্জি অডিট, লজিস্টিক সেবা সম্প্রসারণ, গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ বৃদ্ধির বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ দেন। এছাড়া, কাঠামোগত স্ট্র্যাটেজি, সরবরাহগত স্ট্রাটেজি এবং পলিসি ও রেগুলেটরি স্ট্র্যাটেজি এখাতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার রিসার্চ কাউন্সিল (বিইপিআরসি)-এর সদস্য ড. মো. রফিকুল ইসলাম, পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসি-এর চেয়ারম্যান ড. এম. রেজওয়ান খান, আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ডিসিসিআই এর সাবেক পরিচালক মনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ আমিরুল হক, বাংলাদেশ সাস্টেইনেবল অ্যান্ড রিনিউএবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন (বিএসআরইএ)-এর সভাপতি মোস্তফা আল মাহমুদ, বাংলাদেশ এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন ও কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স আসোসিয়েশনের সভাপতি ইঞ্জি. মো. সিরাজুল মাওলা, বিজিএমইএ সহ-সভাপতি বিদিয়া অমৃত খান এবং ইডকলের উপ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মনিরুল ইসলামসহ আরও অনেকে অংশ নেন।

বিইপিআরসি-এর সদস্য ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তার পরই জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তাই এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সহযোগিতা প্রয়োজন। জ্বালানি উৎপাদনে আমদানির ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হলে ব্যবসায়িক খরচ ক্রমাগত বাড়বে, তাই দেশীয় উৎসের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

তিনি জানান, গত অর্থবছরে জ্বালানি খাতে প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি হয়েছে। তাই এ খাতে দেশীয় বেসরকারিখাতের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির চেয়ারম্যান ড. এম. রেজওয়ান খান বলেন, বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো পরিবর্তন না হলে এ খাতের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এছাড়াও পিক ও অফ-পিক সময়ে বিদ্যুতের দামের পাথর্ক্য নির্ধারণ করতে হবে। সরকারের তেল ক্রয়ের যথাযথ টাকার অভাবেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় বিদুতের সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্প-কারখানা পর্যন্ত পৌঁছানোর বিষয়টিকে সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, প্রয়োজনীয় জ্বালানি না পাওয়ার কারণে প্রায়শই শিল্পখাতে ৫০ শতাংশ পণ্য উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, বিষয়টি মোটেও কাম্য নয়। তাই এ খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে অতিদ্রুত নিরসনের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।

বিসিএমএ-র সভাপতি মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, এলপিজি শিল্পখাতের জ্বালানি নিরপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তবে কোনো আর্থিক প্রণোদনা নেই বরং প্রায় ১০ শতাংশ করারোপ করা রয়েছে, বিষয়টি সমাধানে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

বিএসআরইএ-র সভাপতি মোস্তফা আল মাহমুদ বলেন, প্রতিনিয়ত গ্যাস উত্তোলন কমলেও চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে এবং প্রতিবছর দেশে জ্বালানি চাহিদা ২০ শতাংশ বাড়ছে। তিনি বলেন, জ্বালানি বিষয়ক ভালো নীতিমালা থাকলেও বাস্তবায়ন অবস্থা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। আমাদের উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ শিল্পখাতে ব্যবহৃত হয়, তাই এনার্জি অডিট বাধ্যতামূলক করার বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন ও কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইঞ্জি. মো. সিরাজুল মাওলা বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ২৩০০টি এলপিজি অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন রয়েছে, যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের উদ্যোগ নিলে প্রায় ৭০০-৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এর জন্য একটি কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ণের কোনো বিকল্প নেই। জ্বালানি খাতের বেশ কিছু সরকারি সংস্থা থেকে লাইসেন্স নিতে গিয়ে হয়রানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, এর নিরসনে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

বিজিএমইএ সহ-সভাপতি বিদিয়া অমৃত খান বলেন, আমাদের জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের অবদান মাত্র ৪ শতাংশ, যদিও বৈশ্বিক ক্রেতারা বিষয়টিতে বেশ প্রাধান্য দিচ্ছেন, এক্ষেত্রে নীতিসহায়তার বেশ অভাব রয়েছে। তবে, ভবন স্থাপনে গ্রিন ফান্ড থাকলেও বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে সেটার অনুপস্থিতি রয়েছে।

জ্বালানি খাতে অর্থায়ন অত্যন্ত কষ্টকর বিষয় বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

ইডকলের উপ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মনিরুল ইসলাম বলেন, জ্বালানি খাতের বিদ্যমান নীতিমালাগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নে গ্যাপ রয়েছে, যা শিল্পখাতের সমস্যাকে ক্রমশ প্রকট করছে। এ খাতে অর্থায়ন নিশ্চিতকল্পে গ্রিন বন্ড প্রবর্তনের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।

মুক্ত অলোচনায় ঢাকা চেম্বারের সাবেক ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, প্রাক্তন পরিচালক এম বশিরউল্ল্যাহ ভূইয়্যা এবং সদস্য এম এস সিদ্দিকী অংশ নেন।

ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মানসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা এবং সরকারি-বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

এনএস/এএমএ/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow