হিমালয়ের দেশ নেপাল, যেখানে বরফের চূড়া সারাবছরই শীতলতা ছড়ায়। কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক চিত্র যেন ঠিক তার বিপরীত। অস্থিরতা, আন্দোলন, গৃহযুদ্ধ, সরকার পরিবর্তন আর সাংবিধানিক টানাপোড়েনে বরাবরই উত্তপ্ত নেপালের রাজনীতি। ১৯৫১ সালে রানা রাজবংশের পতনের পর থেকে দেশটি বারবার বিপ্লব, স্বৈরাচার, গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে।
নিচে সংক্ষেপে নেপালের উত্তপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরা হলো—
রানা শাসনের অবসান: গণতন্ত্রের প্রথম স্বপ্ন (১৯৫১)
নেপালের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাস শুরু হয় ১৯৫১ সালে, যখন রানা পরিবারের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রধানমন্ত্রিত্বের শাসনব্যবস্থা উৎখাত হয়। রাজা ত্রিভুবন ভারতে নির্বাসিত অবস্থা থেকে ফিরে এসে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এটি ছিল দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক পরীক্ষা, যা রাজশক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মিলনের সূচনা করে।
কিন্তু এই স্বপ্ন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নেপাল কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কোয়িরালা ১৯৫৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু এই সরকারও অস্থিরতার শিকার হয়।
পঞ্চায়েতের যুগ: রাজার স্বৈরাচারের ছায়া (১৯৬১-১৯৯০)
১৯৬১ সালে রাজা মহেন্দ্র রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে ‘পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থা চালু করেন, যা রাজার কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সংহত করে। এই ব্যবস্থায় কোনো দলীয় রাজনীতি ছিল না, ছিল শুধু রাজা-কেন্দ্রিক স্তরভিত্তিক নির্বাচন। এটি জনগণের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দেয়।
মাওবাদী বিদ্রোহ: গৃহযুদ্ধের আগুন (১৯৯৬-২০০৬)
১৯৯০ সালের প্রথম ‘জনযুদ্ধ’ রাজা বীরেন্দ্রকে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করে এবং পঞ্চায়েতের অবসান ঘটায়। কিন্তু এই গণতন্ত্র অস্থির ছিল। ১৯৯৬ সালে রাজতন্ত্র বিলোপ ও গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে বামপন্থি মাওবাদীরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। এক দশকের সংঘাতে প্রায় ১৭ হাজার মানুষ নিহত হন এবং দেশ ভয়াবহ অস্থিরতায় পড়ে।
২০০১ সালে রাজপরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে রাজা বীরেন্দ্রসহ ১০ জনের মৃত্যু হলে দেশ আরও অস্থির হয়ে ওঠে। রাজা জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতায় এসে আবারও কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করেন। মাওবাদী বিদ্রোহ দমনের নামে সংবিধান স্থগিত করে সরাসরি শাসন চালু করেন তিনি।
২০০৬ সালের দ্বিতীয় ‘জনযুদ্ধ’ (সাত দলীয় জোট ও মাওবাদীদের সমর্থনে বিক্ষোভ) রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে পুরোনো সংসদ ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করে। এই আন্দোলন মাওবাদীদের মূলধারায় নিয়ে আসে এবং রাজতন্ত্রের পতনের পথ প্রশস্ত করে।
প্রজাতন্ত্রের জন্ম: অস্থিরতার চক্র (২০০৮-২০১৫)
২০০৮ সালে গণপরিষদ রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ক্ষমতাচ্যুত করে নেপালকে ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। এর মধ্যে দিয়ে শাহ রাজবংশের ২৪০ বছরের শাসনের অবসান হয়। মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দাহাল (প্রচণ্ড) প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু এই পরিবর্তন স্থায়িত্ব আনে না।
২০০৮ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে, কোনোটিই পূর্ণ পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। নেপাল কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর (সিপিএন-ইউএমএল, মাওবাদী সেন্টার) মধ্যে অস্থায়ী জোট, বিশ্বাসভঙ্গ এবং ক্ষমতার লড়াই অব্যাহত থাকে। ২০১৫ সালে নতুন ফেডারেল সংবিধান গৃহীত হয়, কিন্তু এটি কিছু জাতিগত গোষ্ঠীর (যেমন মাধেশী) অসন্তোষ সৃষ্টি করে, যা আরও অস্থিরতা যোগ করে।
বারবার সরকার পরিবর্তন: জোটের জাল (২০১৫-২০২৪)
২০১৫ সালের পর নেপালের রাজনীতি একটি চক্রে পরিণত হয়—জোট গঠন, ভাঙন, নতুন জোট। কে পি শর্মা ওলি ২০১৫, ২০১৮ এবং ২০২৪-এ প্রধানমন্ত্রী হন, কিন্তু প্রতিবারই অস্থির জোটের কারণে পতন ঘটে। ২০২২-এ শের বাহাদুর দেওয়ানা এবং প্রচণ্ডের মধ্যে জোট ভেঙে যায়, ২০২৪-এ আবার নতুন জোট গঠিত হয়। এই অস্থিরতা দুর্নীতি, নেপোটিজম (রাজনীতিবিদদের সন্তানদের ক্ষমতা দখল) এবং অর্থনৈতিক অসমতাকে বাড়িয়ে তোলে।
জেন জি বিদ্রোহ: অস্থিরতার নতুন মোড় (২০২৫)
২০২৫ সালের আগস্টে সরকার ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করে। একই সময় ‘নেপো কিডস’ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাপন সামনে আসলে তরুণ সমাজের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। গত ৮ সেপ্টেম্বর সোমবার কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ শুরু হয়। এদিন পুলিশের গুলিতে ১৯ জন নিহত হন।
৯ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্ট, সুপ্রিম কোর্ট, সিংহ দরবার এবং নেতাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় ত্রিভুবন বিমানবন্দর। শেষ পর্যন্ত পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী ওলি। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হলে সেনাবাহিনী রাস্তায় নামে, কারফিউ জারি করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, হিমালয়ান টাইমস, কাঠমান্ডু পোস্ট, বিবিসি
কেএএ/