শীতের আগেই ঢাকায় তীব্র গ্যাস সংকট, বেড়েই চলছে ‘সিস্টেম লস’

3 hours ago 4

এখনো শীত আসেইনি। এরই মধ্যে রাজধানীজুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র গ্যাস সংকট। সকালের নাস্তা কিংবা রাতের খাবার রান্না- কোনো সময়ই মিলছে না পর্যাপ্ত গ্যাস। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে ঢাকাবাসী। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎচালিত হিটার বা এলপিজি সিলিন্ডারের ওপর নির্ভর করছেন, যা খরচও বাড়িয়ে দিচ্ছে কয়েকগুণ।

রাজধানীর আজিমপুর, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, খিলগাঁও, বাড্ডা, বাসাবোসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে গ্যাসের চাপ একেবারে কম। দিনে খুব কম সময়ই গ্যাস থাকে। যেটুকু সময় গ্যাস পাওয়া যায় তাতে রান্না করা কষ্টকর। মিটমিট করে জ্বলা চুলায় ভালোভাবে রান্না করাই যেন দায়। চুলায় রান্না বসিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়।

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত ঢাকা কলেজ। কলেজটির আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আবাসিক হলের ম্যানেজার হেলাল উদ্দিন।

দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করা হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘হোস্টেলের রান্নার কাজে গ্যাসের চুলা ব্যবহার করি। এক মাস ধরে এমন অবস্থা যে চুলা জ্বলে না। বাধ্য হয়ে কাঠ দিয়ে রান্না করি। এমন অবস্থা আগে দেখিনি। শীত তো এখনও আসেনি, এখনই গ্যাস পাই না।’

মিরপুরের বাসিন্দা ইতি আক্তার বলেন, ‘গ্যাস নেই বললেই চলে। ভোরে উঠে রান্না করতে হয়, তাও কষ্ট হয়ে যায়। চুলায় কিছু রান্না বসালে অনেক দেরি হয়৷ চুলা যেন জ্বলেই না।’ সকাল ৮টার পর আর গ্যাসই থাকে না।

গ্যাসের সরবরাহ একেবারেই কম থাকায় বাধ্য হয়ে অনেকেই বৈদ্যুতিক হিটার ও সিলিন্ডারে দিকে ঝুঁকছেন। এতে বাড়তি খরচ হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে।

আরও পড়ুন

গ্যাস সংকট নিরসনে ৫ জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব বিজিএমইএর
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের গন্ধ, আতঙ্কিত না হতে পরামর্শ তিতাসের
গ্যাস সংকটে হুমকিতে পোশাক খাত

খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা জেসমিন। স্বামী-সন্তান নিয়ে পরিবারের সদস্য চারজন।

জেসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিমাসে গ্যাসের বিল দেওয়া লাগে। আবার গ্যাস না থাকায় সময়মতো রান্না করতে পারি না। বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার কিনতে হয়েছে। ডাবল খরচ বহন করতে হচ্ছে। আমাদের মতো অল্প আয়ের পরিবারের জন্য এটি কষ্টের। ঠিকভাবে গ্যাস পেলে এই অতিরিক্ত খরচ হতো না।’

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা ইসরাফিল আলম বলেন, ‘গ্যাসের বিল তো প্রতিমাসেই দিতে হয়। যখন গ্যাস থাকে না তখন বৈদ্যুতিক হিটারে রান্না করতে হচ্ছে। দুই দিক থেকেই খরচ হচ্ছে। আমাদের মতো নিম্ন আয়ের পরিবারকে অনেক হিসাব করে চলতে হয়। বাড়তি খরচ চালানো আমাদের জন্য কষ্টের।’

বেড়েই চলছে ‘সিস্টেম লস’

গ্যাসের সিস্টেম লস বলতে বোঝানো হয়, গ্যাস সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থায় উৎপাদিত বা আমদানিকৃত গ্যাসের পরিমাণের সঙ্গে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি হওয়া গ্যাসের পরিমাণের পার্থক্যকে।

অনেক সময় গ্যাস পাইপলাইনে ফাটল, ছিদ্র, সংযোগস্থলে ত্রুটি বা পুরোনো অবস্থা থেকে গ্যাস বেরিয়ে যাওয়া, মিটারে ত্রুটি, অবৈধ সংযোগ বা চুরি, প্রেশার বা ভলিউম ক্ষতি, অপারেশনাল বা মেজারমেন্ট ভুলের কারণে সিস্টেম লস হয়। ঢাকায় গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের সিস্টেম লস বেড়েই চলছে। ফলে বাড়ছে আর্থিক ক্ষতিও।

কোম্পানিটির তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে গ্যাসের সিস্টেম লসের পরিমাণ ৩০৮ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ঘনমিটার (এমএমসিএম)। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩২৩ দশমিক ৬৪ এমএমসিএম, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২০ দশমিক ৫০৭ এমএমসিএম, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮০৬ দশমিক ৫৮৫ এমএমসিএম, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ হাজার ২০৩ দশমিক ৬৫৪ এমএমসিএম এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৯৬ এমএমসিএম গ্যাস সিস্টেম লস হয়েছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, গ্যাস চুরি হচ্ছে, গ্যাস অপচয় হচ্ছে। গ্যাসের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে এলপিজি কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব এখন রাষ্ট্রের দর্শন হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিতাস এগুলো করছে।

তিনি আরও বলেন, এগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব বিউআরসির, সার্বিকভাবে দেখভাল করার দায়িত্ব পেট্রোবাংলা, মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তারা কেউ দেখভাল করে না। একজন সরকারি চাকরিজীবীর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে তার অবলিগেশন (বাধ্যবাধকতা) হচ্ছে এসব অব্যবস্থাপনা থেকে জনগণের জ্বালানি অধিকারকে সুরক্ষা দেবে। সেটি না করে জ্বালানি অধিকার খর্ব করা এবং জ্বালানি অধিকারবিরোধী কাজকর্মকে সুরক্ষা দিচ্ছে। এসব কাজকর্ম অবাধে চলতে সহায়তা করছে। এভাবে কোনো দেশ চলতে পারে না।

তিতাসের অপারেশন ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, এখন গ্যাসের সাপ্লাই কম আছে। এজন্য সংকট দেখা দিয়েছে। এখন আমরা পাচ্ছি ১৫৫০ এমএমসিএফ। কিন্তু আমাদের চাহিদা ১৯০০ এমএমসিএফের বেশি।

সাইদুল হাসান আরও বলেন, ‘প্রতিবছর সরকারের একটা প্ল্যান থাকে যে, বছরে কী পরিমাণ এলএনজি কার্গো কেনা হবে। এই কার্গোগুলো বছরের ১২ মাস সমানভাগে ভাগ করা হয় না। গরমকালে কার্গোগুলো বেশি আনা হয় এবং শীতকালে কম আনা হয়। স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাস আহরণও কমেছে। এখন স্থানীয় উৎপাদন কম। সেই সঙ্গে অক্টোবর, নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে কার্গোগুলো কম পরিমাণে আসবে। আমরা বিদ্যুৎ খাতেও লোড (সরবরাহ) কমিয়েছি। এসব কারণেই টোটাল সাপ্লাই কম আছে।’

গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রাধিকার খাত আছে উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রায়োরিটি লিস্টে প্রথমে বিদ্যুৎ। এরপর সার, শিল্প, ক্যাপটিভ। তারপরে আবাসিক। আমরা ওভাবেই দিচ্ছি। এই লিস্ট ধরেই আমরা গ্যাসের সাপ্লাই দিচ্ছি। তবে এই মুহূর্তে ঢাকায় গ্যাস কম সাপ্লাই হচ্ছে।’

চলতি বছরে সমস্যার সমাধান হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সাইদুল হাসান বলেন, এটা সরকারের ওপর নির্ভর করবে যে, সরকার প্রায়োরিটি কীভাবে সেট করবে। সরকার যদি আমাদের বেশি গ্যাস দিয়ে আবাসিকে বাড়াতে বলে আমরা বাড়াবো।

এনএস/এএমএ/এমএমএআর//এমএস

Read Entire Article