পদত্যাগ করে বিদেশে পালিয়ে থাকা ও গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে আইনি লড়াই করতে চান মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম (জেডআই) খান পান্না।
বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম (জেডআই) খান পান্না জাগো নিউজকে বলেন, সুযোগ থাকলে বা সৃষ্টি হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে আইনি লড়াই করতে চাই।
এর আগে, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আগামী এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
একই ধরনের অভিযোগে ওবায়দুল কাদেরসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালী ৪৫ জনের ক্ষেত্রে পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকে এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গত সোমবার (১৮ নভেম্বর) এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
গত জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেশে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরপর তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তের জন্য দুই মাস সময় চান। তবে ট্রাইব্যুনাল এক মাস সময় মঞ্জুর করে আগামী ১৭ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনও সেদিন জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সারা দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অসংখ্য অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় ও তদন্ত সংস্থার কাছে জমা হয়।
এর মধ্যে একটি মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবং আরেক মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের মধ্যে ৯ জন সাবেক মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাদের বিষয়ে একই আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৭ অক্টোবর থেকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। আর প্রথমবারের মতো শুনানি হলো ট্রাইব্যুনালে।
শুনানি শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, তদন্ত সংস্থার কাছ থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে করা পৃথক মামলার বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। শেখ হাসিনা এখন ভারতে আছেন বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিবেদন দিয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ভারতের সঙ্গে থাকা চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার চেষ্টা করছে সরকার।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সবচেয়ে বড় দায় শেখ হাসিনার বলেও অভিযোগ করেন চিফ প্রসিকিউটর।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আসামিরা বিচারের সময় লড়তে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন। প্রসিকিউশন টিম এ বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করবে না বলে তিনি আশ্বস্ত করেন। নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রসিকিউশন টিম যা যা করা দরকার তা করবে বলে জানান অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।
গত ৯ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অফিসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর এসব কথা বলেন।
আসামিপক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মনে করি আসামিপক্ষ তাদের বেস্ট ডিফেন্স দেওয়ার জন্য আইনজীবী চান—সেটি দেশি হোক, বিদেশি হোক আমাদের পক্ষ থেকে আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই।...তারা যে ধরনের আইনজীবী চান, সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হলে আমাদের পক্ষ থেকে আপত্তি থাকবে না। যাতে কোনো আসামি না বলতে পারেন যে বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তার এই সমস্যা ছিল, ওই সমস্যা ছিল, যে কারণে তিনি ন্যায়বিচার পাননি। এটা যাতে বলতে না পারেন, সে বিষয়ে সরকারও সচেতন আছে, প্রসিকিউশন টিম হিসেবে আমরাও সচেতন আছি। মনে করি বিচার শেষ হওয়ার পরে আসামিপক্ষ এবং বাদীপক্ষ, দুই পক্ষই যে বলে এখানে সুবিচার হয়েছে। কারও প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না, কিন্তু কোনো অপরাধে ছাড়ও কাউকে দেওয়া হবে না—এটা আমাদের পরিষ্কার বার্তা। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য যা যা করার দরকার, তাই করা হবে।’
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো গোপনীয়তা নেই যে রায় নিজেদের মতো করে বানিয়ে দিতে হবে, মিথ্যা কথা বলে তদন্ত সাজাতে হবে—প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের অধিকাংশ এই ঘটনাগুলোর লাইভ উইটনেস। বাংলাদেশের সবার চোখের সামনে অপরাধ ঘটেছে, যা ঘটেছে, যাদের চোখের সামনে ঘটেছে, প্রত্যেকে এসে সাক্ষী দেবেন, তাতে বিচারের রায় যা হওয়ার তা হবে। আমরা কাউকে কোনো অধিকার বঞ্চিত করতে চাই না। সম্পূর্ণ ফেয়ার ট্রায়াল নিশ্চিত করার জন্য প্রসিকিউশন কাজ করবে।’
এফএইচ/এসএইচএস/জিকেএস