বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য শেষ করা হয়েছে। রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) সাক্ষগ্রহণের নির্ধারিত দিনে মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) সাক্ষগ্রহণ করা হবে। তার জবানবন্দি ও জেরায় বেশ কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গ্রহণ শেষ হলে এরপর নিয়ম অনুযায়ী আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষী হওয়ার কথা থাকলেও এই মামলায় আসামি পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে সেই সুযোগ নেই। তার পরিপ্রেক্ষিতে মামলায় যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শুরু হবে।
কবে নাগাদ মামলা শেষ হতে পারে সেটি নিয়ে মুখ খোলেননি প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের কেউই। তবে সাক্ষী গ্রহণ ও যুক্তি-তর্ক শেষ হলেই রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
এ বিষয়ে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম জাগো নিউজকে বলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৫৩ জনের সাক্ষী সম্পন্ন হয়েছে। ৫৪তম সাক্ষী হিসেবে এই মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মো. আলমগীর পিপিএম। তিনি মামলার সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেবেন। তার পরই এই মামলায় সাক্ষী গ্রহণ শেষ হবে।
তিনি বলেন, যেহেতু এই মামলায় দুইজন আসামি পলাতক। তারা কোনো সাফাই সাক্ষী (ডিফেন্স ওইটনেস) দেওয়ার সুযোগ পাবেন না। আইওর সাক্ষী গ্রহণের মাধ্যমে মামলার সাক্ষী গ্রহণ শেষ হচ্ছে। এর পর আমরা এক সপ্তাহ সময় নেব যুক্তিতর্ক প্রস্তুতির জন্য। এরপর ডিফেন্স এর যুক্তিতর্ক কত দিন লাগবে সেটা তারা জানেন।
ডিসেম্বরে মামলার কার্যক্রম শেষ হবে কি না জানতে চাইলে প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়, এত সময় লাগার কথা না। এর আগেই শেষ হতে পারে। অক্টোবর নাকি নভেম্বরে শেষ হবে সেটা বলতে চাননি প্রসিকিউশন।
আরও পড়ুন
‘বাংলাদেশি বোনকে’ ফেরত পাঠান: হাসিনার বিষয়ে মোদীকে ওয়েইসি
শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে ১ ডজন মামলা দুদকের, অপেক্ষা করছে আরও
হাসিনার বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ
সাফাই সাক্ষীর বিষিয়ে রাষ্ট্রীয় খরচে নিযুক্ত (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের আইনজীবী) আইনজীবী মো. আমীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আইন অনুযায়ী (ডিফেন্স) সাফাই সাক্ষী দেওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু আসামি পলাতক। তারা পলাতক না হলে নিজে সাফাই সাক্ষী হিসেবে কথা (সাক্ষী হতে) বলতে পারতেন। তাদেরকে আমি কোথায় পাবো। তারাতো পলাতক। তারা কোনো সাফাই সাক্ষী (ডিফেন্স ওইটনেস) দেওয়ার সুযোগ পাবেন না।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।
গত ১৬ জুন ট্র্যাইব্যুনাল-১ পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে হাজির হতে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন এবং পর দিন দু’টি পত্রিকায় শেখ হাসিনা ও কামালকে সাতদিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়।
তবে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও পলাতক দুই আসামি ট্রাইব্যুনালে হাজির না হওয়ায় তাদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী দিয়ে এই মামলায় অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করেন। সে অনুযায়ী ১০ জুলাই এই মামলায় অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন ট্র্যাইব্যুনাল-১।
ওইদিন রাজসাক্ষী হিসেবে সাবেক আইজিপি মামুন নিজের অভিযোগ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন। পরে আদালত মামুনের আবেদন মঞ্জুর করে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন। এর পর ৩ আগস্ট প্রথম সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মনের জবানবন্দি দিয়ে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে মামলায় সাক্ষী গ্রহণ শুরু হয়।
এর আগে পাঁচ অভিযোগ ও সাড়ে আট হাজারের বেশি নথিপত্র জমা করে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ চলতি বছরের ১ জুন দাখিলের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলো। এর পর অভিযোগ আমলে নেওয়ার মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আট মাস পর এই প্রথম শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো মামলার বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, সেই ট্রাইব্যুনালেই এখন এই বিচার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ মামলার ১৩৪ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। মূল নথিসহ শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো মামলার শুনানি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম তার সূচনা বক্তব্যে বলেছেন, এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা।
ট্রাইব্যুনালে শুনানিতে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বলেছি এ বিচার হবে আবেগশূন্য, তথ্যনির্ভর, প্রমাননির্ভর, নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার। এটি নিশ্চিত করার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করি। বিচারের মাধ্যমে একটা সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এর আগে জুলাই-আগস্টে ১৪০০ মানুষকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষ আহত করা হয়েছে বলেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। নিহতদের তালিকা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়েছে।
এছাড়া অডিও, ভিডিও, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনও দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। এ মামলায় ৮১ জন সাক্ষী ছিল এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫৩ জন সাক্ষী গ্রহণ করা হয়েছে।
এই তিনজনের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, সহায়তা, প্ররোচনা, উসকানি, সম্পৃক্ততার পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। পাঁচ অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওিয়া, আন্দোলনকারীদের দমনে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ, রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্র, অন্যান্য অমানবিক আচরণে মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন৷ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুই ধারনের অভিযোগ রয়েছে।
এই মামলা ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুইটি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়৷ রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্য মামলাটি হয়।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। অভ্যুাত্থানে সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে সেখানেই শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযোগের বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
এফএইচ/এমআইএইচএস/জেআইএম