শেখ হাসিনার রায় ও দায়বদ্ধতা
রাজনীতিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তন নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের পর বিচারপ্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে পূর্ববর্তী শাসকের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড ও উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই গভীর প্রশ্ন ওঠে। গত বছরের জুলাই মাসে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১-এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ড এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের একই সাজা—এই ঘটনা শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বিচারিক স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ড নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। এই রায়টি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নাকি প্রকৃত ন্যায়বিচারের প্রতিফলন—তা বোঝার জন্য পুরো প্রেক্ষাপটের কঠোর ও যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ জরুরি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ কর্তৃক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো স্বভাবতই অত্যন্ত গুরুতর। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে— উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের দমন করার নির্দেশ, রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবু সাঈদ
রাজনীতিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তন নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের পর বিচারপ্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে পূর্ববর্তী শাসকের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড ও উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই গভীর প্রশ্ন ওঠে। গত বছরের জুলাই মাসে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১-এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ড এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের একই সাজা—এই ঘটনা শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বিচারিক স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ড নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। এই রায়টি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নাকি প্রকৃত ন্যায়বিচারের প্রতিফলন—তা বোঝার জন্য পুরো প্রেক্ষাপটের কঠোর ও যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ জরুরি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ কর্তৃক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো স্বভাবতই অত্যন্ত গুরুতর। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে— উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের দমন করার নির্দেশ, রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা, ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ। এই অভিযোগগুলো যদি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, তবে তা নিশ্চিতভাবেই মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় আসে এবং সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিচারিকভাবে কঠোর দণ্ড ঘোষণা করতেই পারে। ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি হলো—কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী হলেও অপরাধ প্রমাণ হলে শাস্তি পাওয়া ন্যায়বিচারেরই অংশ।
ঘটনার একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—২০০৯ সালে শেখ হাসিনাই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। সেই ট্রাইব্যুনালই পরবর্তীতে জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ডও ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এখন ক্ষমতাবদলের পর একই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে জুলাই আন্দোলনের বিচার করছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একই কাঠামোর আদালত তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করছে—এটি প্রমাণ করে যে ক্ষমতা স্থায়ী নয়, এবং বিচারিক প্রক্রিয়া অনেক সময় ক্ষমতার নতুন কেন্দ্রের দিকেও মোড় নিতে পারে। তবে এই বাঁক পরিবর্তন কি সত্যিই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করছে, নাকি ক্ষমতান্তরিত প্রতিহিংসার রূপ—প্রশ্নটি এখানেই।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু বিচার ঘোষণাই যথেষ্ট নয়; বিচারপ্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা, স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। এখানেই বর্তমান বিচারিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো—যে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এই বিচার চলছে, সেই সরকার এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। গত এক বছরে মানবাধিকার সংগঠনগুলো গুম, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নির্যাতন, বিচারহীনতা এবং অবৈধ দমন-পীড়নের অসংখ্য অভিযোগ তুলেছে। যারা আজ পূর্ববর্তী শাসকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করছে, তাদের নিজেদের আমলেই সংঘটিত অনুরূপ অপরাধের কোনো বিচার হচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার বদলে বরং নির্বিচারে গ্রেপ্তার, মবসন্ত্রাস, সন্দেহজনক হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও দমন-পীড়নও কমেনি।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা গ্রহণ করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৪ মাসের শাসনামলে মোট ৪০ জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন: ১৯ জন, নির্যাতনে মারা গেছেন: ১৪ জন, পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে: ৭ জনকে।
বিচার মানে শুধু শাস্তি নয়—বিচার মানে সত্য, স্বাধীনতা, দায়বদ্ধতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা। এই ট্রাইব্যুনালের রায় যদি কেবল সাবেক শাসককে শাস্তি দেওয়ার রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়, তবে তা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় থাকবে। কিন্তু যদি বিচারটি হয় স্বাধীন, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ—এবং একইসঙ্গে বর্তমান শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও বিচার নিশ্চিত হয়—তাহলে এটিই প্রকৃত ন্যায়বিচারের পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে।
এছাড়া ১৪ মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৫৩ জন, রাজনৈতিক সহিংসতা ৭,৯৭৯টি, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ২৮১ জন, সাংবাদিকদের উপর হামলা ২৪২টি। আগস্ট ২০২৪ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে। এই ব্যাপক সহিংসতা, গুম ও বিচারহীনতা সমাজের মনে এই ধারণা জন্মায় যে ভিন্নমত দমন করাই যেন মূল উদ্দেশ্য। যে রাষ্ট্র নিজেই বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, তার অধীনে হওয়া বিচারপ্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
উল্লেখ্য, এই পরিস্থিতিটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিল। সেই সরকারের পতনের পর, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যার একজন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধিকার-এর প্রতিষ্ঠাতা আদিলুর রহমান খান। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিতর্কিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন আদিলুর। জুলাই অভ্যুত্থানের পর হাইকোর্টের রায়ে তিনি খালাস পান।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনগণ আশা করেছিল বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ হবে। কিন্তু অধিকার-এর তথ্য বলছে—সরকার পরিবর্তনের পরও পরিস্থিতি খুব একটা আলাদা নয়। এটি নির্দেশ করে—আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহির ঘাটতি কাঠামোগত, এবং যে-ই ক্ষমতায় থাকুক, এই সমস্যাটি থেকে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারে মানবাধিকারকর্মী থাকলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমেনি—এটি দেখায়, অপরাধের শিকড় আরও গভীর।
এদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও সংকুচিত হয়েছে। গত এক বছরে সাংবাদিকদের ওপর অন্তত ৬৭টি হামলা, হয়রানি বা গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষত ‘সাইবার সিকিউরিটি আইন ২০২৩’ ব্যবহার করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ায় মিডিয়ার স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হয়েছে। একটি স্বাধীন গণমাধ্যম বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার অন্যতম রক্ষাকবচ—এ সুযোগ কমে গেলে সত্য উদঘাটনের পথও সংকুচিত হয়।
মামলা গঠন, তদন্ত পরিচালনা ও অভিযোগ আনার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ রয়েছে। একই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার একই রকম হতে হবে—ন্যায়বিচারের মৌলিক এই নীতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় এসেছে দ্রুত ও কঠোরভাবে, কিন্তু বর্তমান শাসনামলে ঘটে যাওয়া অপরাধগুলো বিচারবহির্ভূত রয়ে গেছে। এই বৈষম্য বিচারিক সততা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করে। যখন বিচার কেবল ক্ষমতাচ্যুতদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়, তখন তা ন্যায়বিচার নয়, রাজনৈতিক প্রতিশোধের মতো দেখায়।
সব মিলিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট—অপরাধ প্রমাণ হলে শাস্তি হবেই, এটি ন্যায়বিচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়টি তখনই গ্রহণযোগ্য হবে, যখন এই বিচারপ্রক্রিয়ার প্রশ্নগুলো স্বচ্ছভাবে মিটে যাবে। একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে বিচার এমন হওয়া উচিত যাতে ক্ষমতার পালাবদলে বিচারও পাল্টে না যায়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ঢালাওভাবে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের মুক্তি দিয়েছে— তেমন কোনো পর্যালোচনা ছাড়াই। এটি একটি বিপজ্জনক নজির। বিচারব্যবস্থা যখন রাজনৈতিক প্রভাবের নিচে চাপা পড়ে, তখন বিচার আর ন্যায়বিচারের মর্যাদা ধরে রাখতে পারে না— থেকে যায় কেবল শাস্তি দেওয়ার রাজনৈতিক প্রদর্শনী। বর্তমান পরিস্থিতিও সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।
এই অবস্থায় রাষ্ট্রের ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই উত্তরণের একমাত্র পথ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে, সব নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করতে হবে, এবং সব পক্ষের বিরুদ্ধে একই মানদণ্ডে তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।
বিচার মানে শুধু শাস্তি নয়—বিচার মানে সত্য, স্বাধীনতা, দায়বদ্ধতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা। এই ট্রাইব্যুনালের রায় যদি কেবল সাবেক শাসককে শাস্তি দেওয়ার রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়, তবে তা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় থাকবে। কিন্তু যদি বিচারটি হয় স্বাধীন, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ—এবং একইসঙ্গে বর্তমান শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও বিচার নিশ্চিত হয়—তাহলে এটিই প্রকৃত ন্যায়বিচারের পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে।
স্বাভাবিকভাবেই মানুষ প্রশ্ন তোলে—বিচার কখন সবার জন্য সমান হবে? রাষ্ট্র কখন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে?
উত্তরটি সহজ নয়, কিন্তু পথটি স্পষ্ট—আইনের চোখে সবাই সমান, এই নীতি প্রতিষ্ঠাই একমাত্র মুক্তির পথ।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম
What's Your Reaction?