শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতান

মওলবি আশরাফ টিপু সুলতান ছিলেন মহীশূর (Mysore) রাজ্যের সুলতান; যার শাসনকাল ছিল ১৭৮২ থেকে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দ। এই সময়কালে তিনি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের আতংক হয়ে উঠেছিলেন, তিন-তিনটি বড় যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন—যা ইংরেজ–মহীশূর যুদ্ধ (Anglo-Mysore Wars) নামে পরিচিত। পাক-ভারত-বাংলায় তাকে সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়, এবং তার উপাধী দেওয়া হয়—শের-ই-মহীশূর বা টাইগার অব মাইসোর। এখানে আমরা তার জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নেব। জন্ম ও শিক্ষা টিপু সুলতানের জন্ম ২০ নভেম্বর ১৭৫০, ভিন্নমতে ১ ডিসেম্বর ১৭৫১, মহীশূর রাজ্যের দেবনহল্লিতে (বর্তমান বেঙ্গালুরু, কর্ণাটক রাজ্য)। তার পূর্ণ নাম: নাসিবুদ্দৌলা আমিরে ওয়াতান সুলতান ফতেহ আলি সাহাব টিপু। তার পিতা হায়দর আলি ছিলেন এক মুসলিম সামরিক কর্মকর্তা, যিনি পরে হিন্দু ওয়াদিয়ার রাজবংশকে সরিয়ে দিয়ে মহীশূর রাজ্যের শাসক হয়ে ওঠেন। মা ফাতেমা ফখরুন্নেসা ছিলেন বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের কড়াপ্পা অঞ্চলের গভর্নরের কন্যা। তার আরেকটি পরিচয় হলো তিনি কুরাইশ বংশের, তার পূর্বপুরুষ মক্কা থেকে হিন্দুস্তানে এসেছিলেন। শিক্ষাজীবনে টিপু সুলতানের পাঠ্যসূচিতে ছিল কোরআন, ইসলামি আইনশাস্ত্র, সাধার

শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতান

মওলবি আশরাফ

টিপু সুলতান ছিলেন মহীশূর (Mysore) রাজ্যের সুলতান; যার শাসনকাল ছিল ১৭৮২ থেকে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দ। এই সময়কালে তিনি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের আতংক হয়ে উঠেছিলেন, তিন-তিনটি বড় যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন—যা ইংরেজ–মহীশূর যুদ্ধ (Anglo-Mysore Wars) নামে পরিচিত। পাক-ভারত-বাংলায় তাকে সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়, এবং তার উপাধী দেওয়া হয়—শের-ই-মহীশূর বা টাইগার অব মাইসোর। এখানে আমরা তার জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নেব।

জন্ম ও শিক্ষা

টিপু সুলতানের জন্ম ২০ নভেম্বর ১৭৫০, ভিন্নমতে ১ ডিসেম্বর ১৭৫১, মহীশূর রাজ্যের দেবনহল্লিতে (বর্তমান বেঙ্গালুরু, কর্ণাটক রাজ্য)। তার পূর্ণ নাম: নাসিবুদ্দৌলা আমিরে ওয়াতান সুলতান ফতেহ আলি সাহাব টিপু। তার পিতা হায়দর আলি ছিলেন এক মুসলিম সামরিক কর্মকর্তা, যিনি পরে হিন্দু ওয়াদিয়ার রাজবংশকে সরিয়ে দিয়ে মহীশূর রাজ্যের শাসক হয়ে ওঠেন। মা ফাতেমা ফখরুন্নেসা ছিলেন বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের কড়াপ্পা অঞ্চলের গভর্নরের কন্যা। তার আরেকটি পরিচয় হলো তিনি কুরাইশ বংশের, তার পূর্বপুরুষ মক্কা থেকে হিন্দুস্তানে এসেছিলেন।

শিক্ষাজীবনে টিপু সুলতানের পাঠ্যসূচিতে ছিল কোরআন, ইসলামি আইনশাস্ত্র, সাধারণ বিজ্ঞান, তরবারি চালানো, ঘোড়সওয়ারি, আরবি–ফারসি ভাষা ইত্যাদি।

কিন্তু শুধু বই-পুস্তক নয়—ছেলেবেলা থেকেই বাস্তব রাজনীতি ও ক্ষমতার উত্থান–পতন তিনি চোখের সামনে দেখেছেন। তার পিতা হায়দর আলি ছিলেন দূরদর্শী মানুষ। তিনি জানতেন ইংরেজদের পরাজিত করতে ইউরোপীয় সামরিক কৌশল জানা লাগবে। তাই তিনি ফ্রেঞ্চদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, এবং ফরাসি অফিসারদের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। টিপু সুলতান বাল্যকালে তাদের কাছ থেকেই সামরিক কৌশল শেখেন।

শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতান
টিপু সুলতানের জন্মস্থান ছবি: সংগৃহীত

যুদ্ধজীবন

ছেলেবেলা থেকেই টিপু সুলতান বাবার সঙ্গে রণাঙ্গণ থেকে রণাঙ্গণে ছুটে বেড়িয়েছেন। ১৭৬৬ সালে, টিপু সুলতান সবে ষোলোতে পা রেখেছেন, তখনই তিনি প্রথমবারের মতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তার প্রথম মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় প্রথম ইংরেজ–মহীশূর যুদ্ধে (১৭৬৭–৬৯), যেখানে তিনি বাবার সঙ্গে মিলে ইংরেজ ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে লড়েন। এই যুদ্ধ তাকে শুধু একজন দক্ষ সৈনিক হিসেবে নয়, একজন কূটনীতিক হিসেবেও নিজেকে প্রমাণের সুযোগ দেয়। এই সময়ই হায়দরাবাদের নিজামের কাছে তাকে পাঠানো হয়—যেন নিজাম ব্রিটিশদের পক্ষে না দাঁড়িয়ে হায়দর আলির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকেন।

১৭৬৭ সালেই টিপু মারাঠাদের বিরুদ্ধে কর্ণাটক অঞ্চলে একদল ঘোড়সওয়ার বাহিনীর অধিনায়ক হন এবং ১৭৭৫ থেকে ১৭৭৯ সাল পর্যন্ত মারাঠাদের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ১৭৮০–৮৪ সালের দ্বিতীয় ইংরেজ–মহীশূর যুদ্ধে পল্লিলুরে (১৭৮০ সালে) তিনি জয়লাভ করেন, এরপর ১৭৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোল্লিডম (Coleroon) নদীর তীরে কর্নেল জন ব্রেথওয়েটকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধ চলাকালেই তার পিতা হায়দর আলি যুদ্ধক্ষেত্রে ইন্তেকাল করেন, এবং ১৭৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে টিপু সুলতান আনুষ্ঠানিকভাবে তার উত্তরসূরি হিসেবে সিংহাসনে বসেন।

১৭৮৪ সালে তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে মাঙ্গালোর চুক্তি (Treaty of Mangalore) করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে মহীশূরের সুলতান উপাধি ধারণ করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন শান্তি টেকেনি। ১৭৮৯ সালে টিপু ব্রিটিশদের মিত্র ত্রাভাঙ্কোরের রাজাকে আক্রমণ করলে ব্রিটিশরা তৃতীয় ইংরেজ–মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯০–৯২) শুরু করে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে তিনি প্রচণ্ড লড়াই করে ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত ১৭৯২ সালের সেরিংগাপাটম চুক্তির (Treaty of Seringapatam) মাধ্যমে তাকে নিজের অর্ধেক ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে হয়, বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, এমন কি নিজের দুই ছেলেকে জিম্মি হিসেবে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন।

শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতান
ভারতের আর্মি জাদুঘরে সংরক্ষিত টিপু সুলতানের শিরস্ত্রাণ ছবি: সংগৃহীত

তবু তিনি থেমে যাননি। তিনি ফ্রান্সের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক মজবুত করতে থাকেন। ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সের নতুন সরকার তার পক্ষে থাকবে—এমন আশ্বাসও তিনি পান। কিন্তু কূটনৈতিক ভুলে তিনি এই আলোচনা গোপন রাখতে পারেননি; ইংরেজদের কানে খবর পৌঁছে যায়। একে অজুহাত বানিয়ে মাদ্রাজের গভর্নর ও বাংলার গভর্নর জেনারেল রিচার্ড কোলি ওয়েলেসলি ১৭৯৯ সালে চতুর্থ ইংরেজ–মহীশূর যুদ্ধ শুরু করেন। ৪ঠা মে ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন বাহিনী সুলতানের রাজধানী সেরিংগাপাটমে আকস্মিক হামলা চালায়, এবং প্রাচীর ভেঙে শহরে ঢুকে পড়ে। টিপু সুলতান তখন দুর্গের ফটকে দাঁড়িয়েই লড়াই চালিয়ে যান। সেই শেষ মুহূর্তে তার বিখ্যাত উক্তি—‘শেয়ালের মতো একশো বছর বেঁচে থাকার চেয়ে বাঘের মতো এক দিনের বেঁচে থাকা উত্তম’—একে তিনি বাস্তবে প্রমাণ করেন। তিনি লড়াই করতে করতে শাহাদাত বরণ করেন।

শাসক হিসেবে টিপু সুলতান

টিপু সুলতান শুধু ময়দানের কমান্ডারই ছিলেন না, শাসক হিসেবেও তিনি ছিলেন দক্ষ। তিনি নতুন ভূমি-রাজস্বব্যবস্থা চালু করেন, বিভিন্ন ধরনের নতুন মুদ্রা প্রবর্তন করেন এবং ‘মওলুদি ক্যালেন্ডার’ নামে নিজস্ব সাল-গণনা পদ্ধতি চালু করেন। তার তৈরি লৌহনির্মিত রকেট—যা ‘মাইসোরিয় রকেট’ নামে পরিচিত—সমরবিজ্ঞানে এক বড় উদ্ভাবন হিসেবে ধরা হয়। হায়দর আলি যদিও আগে থেকেই রকেট অস্ত্র ব্যবহার করতেন, টিপু সেটাকে নতুন নকশা, ধাতব নল ও দীর্ঘ স্ট্যাবিলাইজিং রড দিয়ে অনেক বেশি কার্যকর ও ভয়াবহ করে তোলেন। পরে এই নকশা থেকেই ব্রিটিশরা Congreve rocket তৈরি করে। এ কারণেই ড. এ.পি.জে. আবদুল কালাম তাকে বলেছেন ‘হিন্দুস্তানের প্রথম মিসাইলম্যান’।

টিপু সুলতান মূলত তার বাবার গড়া রাজ্যকে আরও প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন; এজন্য তিনি কোচিন, ত্রাভাঙ্কোর, কুর্গ (আজকের কোডাগু), মালাবার—এ সব পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রতি কঠোর নীতি অবলম্বন করেন। যাদের তিনি বিদ্রোহী বা রাষ্ট্রবিরোধী মনে করতেন, তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতেন।

টিপু সুলতান ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সর্বশেষ শক্তিশালী বাধা। ব্রিটিশ, মারাঠা ও নিজাম—এই তিন শক্তি একজোট হয়ে তাকে পরাস্ত করে।

শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতান
সেরিংগাপাটমে টিপু সুলতানের সমাধিসৌধ ছবি: সংগৃহীত

বিজেপি শাসিত ভারতে টিপু সুলতান

বর্তমান ভারতে টিপু সুলতানের অবদান অস্বীকার করা হয় না বটে, কিন্তু তাকে যতটা সম্ভব আলোচনার বাইরে রাখা হয়। বিবিসি বাংলার তথ্যমতে কর্ণাটকের সাবেক বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পা জানিয়েছেন, ‘টিপু জন্মজয়ন্তী আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুল পাঠ্য বইতে যা রয়েছে টিপু সুলতানের সম্বন্ধে, সেগুলোও সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি আমরা।’ বিজেপির এক নেতা এর আগে দাবি করেছিলেন যে টিপু সুলতানকে যেভাবে গৌরবান্বিত করা হয় স্কুলের পাঠ্য বইগুলিতে, তা বন্ধ করা উচিত। টিপু সুলতানের ওপরে বহুদিন ধরে গবেষণা করেছেন মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান জোসেফ। তিনি বলেন টিপু সুলতানকে ভারতীয় ইতিহাসের একজন ‘খলনায়ক’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের বক্তব্য—টিপু সুলতান হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চালাতেন। অথচ টিপু সুলতান যখন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতেন, তখন তার ভারপ্রাপ্ত হয়ে শাসন করতেন পুন্নাইয়া নামের একজন হিন্দু। আবার মালাবার অভিযানের করার সময়েও টিপুর সেনাপতি ছিলেন শ্রীনিবাস রাও—তিনিও হিন্দু।

মালাবারের ইনায়ম (অনুদান) নথি থেকে জানা যায়—তিনি বহু হিন্দু মন্দিরকে ভাতা ও অনুদান দিতেন। শৃঙ্গেরি মঠের শঙ্করাচার্যের সঙ্গে তার যে বহু চিঠি বিনিময় হয়েছে—‘শৃঙ্গেরি পত্রাবলি’ নামে পরিচিত সেই দলিলগুলোয় দেখা যায়, তিনি তাকে সম্মান দেখিয়েছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্যও পাঠিয়েছেন।

ওএফএফ/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow