শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের কী লাভ?

10 hours ago 8

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংস্কার-আকাঙ্ক্ষা থেকে সর্বশেষ শেয়ারবাজার সংস্কারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি গঠিত টাস্কফোর্স তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে এক হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন করা কোম্পানিকে সরাসরি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা হোক। একইভাবে, ব্যাংক থেকে এক হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়া কোম্পানিকেও তালিকাভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে।

এ ছাড়া, টাস্কফোর্সের অন্যতম সুপারিশ হলো—শেয়ারবাজারে আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) এর মাধ্যমে কোন কোম্পানি বাজারে আসবে এবং কোন কোম্পানি অনুমোদন পাবে, সে বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেবে স্টক এক্সচেঞ্জগুলো। করপোরেট সুশাসন পেশাজীবী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ব্যক্তি- মালিকানাধীন বড় কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার খবরদারি পছন্দ করে না। নিজেদের পর্যাপ্ত মূলধন থাকলে উদ্যোক্তারা সাধারণত পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলতে চান না। আবার সহজশর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ পেলে কোম্পানিগুলো সহজে পুঁজিবাজারমুখী হতে চায় না। কারণ, তালিকাভুক্তির সঙ্গে খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আইন পরিপালনের বিষয়টিও সামনে চলে আসে।

উন্নত বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোতে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগের বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির অংশ হলেও, বাংলাদেশে স্থানীয় কোম্পানিগুলো বাধ্য হয়েই স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ করেন। তবে ভালো কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে মালিকরা যা চান, তা অনেকদিন হলো মিলছে না। উদ্যোক্তারা বহুদিন ধরে বলে আসছেন—তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার যদি উল্লেখযোগ্যভাবে পৃথক না থাকে, তাহলে মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলো বাজারে আসবে না।

বর্তমানে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে শর্তপূরণ সাপেক্ষে ২০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। অন্যদিকে, অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য এই হার মাত্র ৫ থেকে ৭.৫ শতাংশ বেশি। উদ্যোক্তারা চাইছেন, এই ব্যবধান ১০ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করা হোক। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোও এ দাবি জানিয়েছে। তবে, আদতে এটি একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ফলে বাধ্য করার পরিবর্তে কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করার দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া সমীচীন।

গণমাধ্যম সংসার কমিশনের প্রতিবেদন-

পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের এই প্রতিবেদন হস্তান্তরের কয়েকদিন আগে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য সংস্কারের লক্ষ্যে তাদের সুপারিশমালা উপস্থাপন করেছে। সেখানে শর্তসাপেক্ষে কিছু গণমাধ্যমকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। কেন্দ্রিভূত মালিকানা কাঠামোর কারণেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমাধ্যম প্রকৃত অর্থে গণমাধ্যমের মৌলিক আচরণ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে—এ কথা বিজ্ঞ মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছেও আলোচিত বিষয়।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত গণমাধ্যম কমিশনও তাই যথার্থভাবে মালিকানা কাঠামো বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশমালায় এই প্রক্রিয়ার পদ্ধতি উল্লেখ করেছে। উন্নত বিশ্বের উদাহরণ সামনে রেখে আমাদের গণমাধ্যমকেও কীভাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা যায়, সেটি গুরুত্বসহকারে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো মিডিয়া হাউজ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, যদিও একই মালিকানা বা গ্রুপভুক্ত অন্যান্য কোম্পানির তালিকাভুক্তির অনেক উদাহরণ রয়েছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের চুম্বক অংশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। কমিশন প্রথম পর্যায়ে মাঝারি ও বৃহৎ মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে সর্বসাধারণের জন্য শেয়ার ছাড়া ও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করার সুপারিশ করেছে।

তবে প্রশ্ন হলো—গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন কি পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সাথে এই বিষয়ে কোনো আলোচনা করেছে? পত্রিকার খবর পাঠ করে এমন কোনো তথ্য অবশ্য পাওয়া যায়নি।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকদের শেয়ারধারীদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। বার্ষিক সাধারণ সভায় পরিচালকদের কাছে শেয়ারধারীরা কোম্পানি পরিচালনা বা পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগ পান। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের মাধ্যমে গণমাধ্যম পুঁজিবাজারে এলে একই প্রক্রিয়ায় শেয়ারধারীরা জবাবদিহি চাইতে পারবেন। উন্নত বিশ্বে অধিকাংশ বড় গণমাধ্যম কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সাংবাদিকতার স্বার্থ রক্ষায় জবাবদিহির এমন উদাহরণ কমিশনও দেখিয়েছে।

পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহের মাধ্যমে উৎকর্ষতার সঙ্গে গণমাধ্যম পরিচালনা করা নিঃসন্দেহে একটি লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই পরামর্শ বাস্তবায়ন করা কতটা সম্ভব? লোকসানে থাকা কোনো কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার নিয়ম নেই। নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজন, অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির স্বার্থে হিসাব নিরীক্ষার অভ্যাস আছে—এমন প্রতিষ্ঠানও খুব বেশি নেই।

শুধু তাই নয়, আইপিওতে আসতে হলে কর্পোরেট সুশাসন ও ডিউ ডিলিজেন্সের যে দীর্ঘ শর্ত পূরণ করতে হয়, অধিকাংশ মিডিয়া কোম্পানি সেসবের ধারে-কাছেও নেই। লোকসানের অজুহাতে কর্মীদের কম বেতন দেওয়া, সুযোগ সুবিধার ঘাটতি, অনিয়মিত বেতন প্রদান—বড় মিডিয়া হাউজগুলোরই বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক এই পেশায় সাধারণত সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলেমেয়েরাই আসেন। কিন্তু একই সমান শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে কম বেতন দেওয়ার নজিরও গণমাধ্যমেই রয়েছে। গণমাধ্যম মালিকদের এইসব বদ অভ্যাস পরিবর্তনের আশাতেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে।

এমনিতেই দুর্বল কোম্পানির ভারে পুঁজিবাজারের অবস্থা বরাবরই শোচনীয়। এই বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করলে প্রতিযোগিতামূলক মুনাফা বিতরণ করে এমন কোম্পানি একদমই হাতে গোনা। তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির কর্পোরেট সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ। বাজারে আসার আগে অধিক মুনাফা দেখানো শক্তিশালী কোম্পানিও কয়েক বছরের মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়ে—এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। মালিকপক্ষ বা উদ্যোক্তা পরিচালকদের ব্যবসা পরিচালনায় মনোযোগের অভাব কিংবা মুনাফা লুটের প্রবণতার কারণেই কোম্পানিগুলো দুর্বল হয়।

তাহলে প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশের বাস্তবতায় বছরের পর বছর লোকসান দেখানো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে যদি সরাসরি অথবা ভিন্ন কোনো নির্দেশনার মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করে মূলধন সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হয়, তবে বিনিয়োগকারীরা কোন ভরসায় বিনিয়োগ করবেন? শুধু কাগজে-কলমে গণমাধ্যমের মালিক বনে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কী লাভ হবে? এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নতুন দিনে উত্তরণে সমাধান হিসেবে মাঝারি ও বড় মিডিয়া হাউজগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা কীভাবে হবে—তা নিয়ে বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে নিশ্চয়ই কোনো উদ্ভাবনী পরামর্শ নিয়ে হাজির হতে হবে।

লেখক : চার্টার্ড সেক্রেটারি। সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article