শৈশবের ঈদ আনন্দ

3 months ago 53

নাহিদ হোসাইন
কুরবানি ঈদের কয়েকদিন আগ থেকেই এলাকার বাতাসের গন্ধ বদলে যেতো। সবার মধ্যে আনন্দ বিরাজ করতো, মুরুব্বীরা মাথায় হাত দিয়ে বলতেন গরুটা দেখে আসিস। বাড়ির উঠানে পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ, চারপাশে গরুর হাম্বা ধ্বনি, চাকু শান দেওয়ার শব্দ, সব মিলিয়ে একটা উষ্ণ ব্যস্ততা ঘিরে ধরত আমাদের চারপাশ। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল ঈদের আগের দিনের ঈদ মিছিল। আমরা ছড়া কাটতাম-

সাদা গরুর কালা শিং
রাত পোহাইলে ঈদের দিন।

ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন বোতলে শব্দ করে হাততালি দিয়ে ছড়া কাটতাম। টিনের কৌটা ফুটো করে তাতে মোমবাতি লাগিয়ে ঘুরাতাম। লোডশেডিং ছিল যেন আমাদের আনন্দের সঙ্গী। সন্ধ্যা নামলেই বিদ্যুৎ চলে যেত, আর অন্ধকারে মোমবাতির আলোয় আমাদের আনন্দ মিছিলটা জ্বলজ্বল করতো। মনে হতো ঈদ বুঝি আমাদের গালে এসে বসে আছে। প্রতিবেশীদের বাড়িতে গরু দেখতে যেতাম। কে কোথা থেকে এনেছে, কারটা মোটা, কারটা দামি—এসব নিয়েই চলত আলোচনা। প্রতি ঈদে সেরা গরু নির্বাচন করা ছিল আমাদের বিশেষ দায়িত্ব।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলে রাস্তায় সারি সারি গরু যেতো এবং গরুগুলো সাজানো থাকতো নানা রঙে। গলায় মালা, পিঠে ফিতা, কপালে ঝলমলে আবরণে মনে হতো গরুগুলো অন্য এক পৃথিবী থেকে এসেছে। এক বিকেলে বাবা বললেন, “চল, হাটে যাবি?”

আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে উঠলাম। বাবার হাত ধরেছিলাম শক্ত করে। সেই হাট—সেই বিশাল বিশাল গরু, কোলাহল, তখনই প্রথম অনুভব করলাম। গরু কেনা শুধু একটি লেনদেন নয়, এটি এক অন্য রকম অনুভূতি ভালোবাসা আর কর্তব্যের।

যেদিন গরুটা বাসায় এলো, আমি তার গলায় হাত রেখেই বুঝলাম—এ শুধু গরু নয়। এ যেন আমার নতুন বন্ধু। আমি তাকে খড় খাওয়াতাম, ঘাস কেটে দিতাম, তার কপালে হাত বুলিয়ে বলতাম, “কি খবর? ”

সে কিছু বলত না, কিন্তু তার চোখের ভেতর এক ধরনের নীরবতা ছিল—যা ভাষার চাইতেও স্পষ্ট। ঈদের আগের রাতটা ছিল ঘুমহীন এক উত্তেজনার রাত, মনে মনে গুণতাম কত সময় বাকি। সকালে বোন বলত, “ভাই, আজ ঈদ—তাড়াতাড়ি চল!”

নতুন পাঞ্জাবি পরে আমি গরুর গলায় আবার হাত রাখতাম। ঈদের নামাজ শেষ করে ফিরে এসে যখন সবাই গরুর চারপাশে জড়ো হত, তখন বুকের মধ্যে কেমন একটা ঢেউ উঠত—ভয়, ভালোবাসা আর বেদনার মিলেমিশে অজানা এক কাঁপুনি। তখন বুঝতাম না কেন মন ভার হয়ে আসে। শুধু বুঝতাম, কিছু একটা চিরতরে চলে যাবে।

আজ, অনেক বছর পর, আমি এখন বড়। ঈদ আসে, আলো আসে, গরু আসে, ছবি তোলা হয়, মাংস ভাগ করা হয়।

তবু সন্ধ্যা নামলে মনে পড়ে সেই আনন্দের মিছিল, সেই ছড়ার প্রতিধ্বনি।

এমআইএইচ/জেআইএম

Read Entire Article