শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ-নেপাল, এরপর কোন দেশ?

3 hours ago 3

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র যেন নতুন করে আঁকা হচ্ছে। এক সময় যেসব সরকার দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় ছিল, একের পর এক সেই সরকারগুলোকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে— এ আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেনারেশন জেড বা জেন-জি। তাদের স্লোগান, আন্দোলন ও রাস্তায় নামা এখন আর কোনো দেশের জন্য আলাদা ঘটনা নয়; বরং এটি যেন একটি ধারাবাহিকতা তৈরি করেছে।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে সরকারের পতনের মাধ্যমে এ ধারা শুরু হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায় ঘটে। সবশেষ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলিকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশেই একই চিত্র—অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং তরুণদের অসন্তোষ মিলেমিশে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো— এরপর কার পালা? কোন দেশ হবে পরবর্তী শিকার?

শ্রীলঙ্কা : অর্থনৈতিক পতন থেকে গণঅভ্যুত্থান

শ্রীলঙ্কার পতনের সূচনা অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশটি ভয়াবহ খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ সংকটে পড়ে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন, পর্যটন খাতের ধস, দুর্নীতি এবং অদূরদর্শী নীতির ফলে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার মুখে পড়ে।

এই পরিস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামে। ‘গোটা গো হোম’ আন্দোলনের স্লোগানে গোতাবায়া রাজাপাকসের বিরুদ্ধে কলম্বো কেঁপে ওঠে। আন্দোলনকারীরা প্রেসিডেন্ট হাউস দখল করে তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তছনছ করে। অবশেষে পালিয়ে গিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন গোতাবায়া। এক পরিবারের আধিপত্য ভেঙে নতুন অধ্যায় শুরু হয় দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে।

বাংলাদেশ : কোটা আন্দোলন থেকে সরকারের পতন

বাংলাদেশে পতনের সূচনা হয় ২০২৪ সালের জুলাইয়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে সরকার দমননীতি চালালেও পুলিশের গুলি, নিহতদের সংখ্যা ও সহিংসতা আন্দোলনকে আরও ঘনীভূত করে।

ধীরে ধীরে এ আন্দোলন সরাসরি শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে রূপ নেয়। সেনাবাহিনী আন্দোলন দমনে অস্বীকৃতি জানালে হাসিনা রাজনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েন। ৫ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস যার নেতৃত্ব দেন।

নেপাল : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা থেকে বিদ্রোহ

২০২৫ সালে নেপালে ওলি সরকারের পতন হয় ভিন্ন একটি কারণে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ দুই ডজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার পর তরুণদের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। স্কুল পোশাক পরে, বই হাতে নিয়ে ছাত্ররা রাস্তায় নামে, যা বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায় ‘জেন জি বিদ্রোহ’ নামে।

সরকার দমননীতিতে গেলেও তা কার্যকর হয়নি। কয়েকজন মন্ত্রীর পদত্যাগের পর অবশেষে নিজেও পদত্যাগে বাধ্য হন ওলি। বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এরপর কার পালা?

তিনটি দেশেই একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়— শাসকের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা, জনগণের জীবনযাত্রার ব্যর্থতা, তরুণ প্রজন্মের আস্থাহীনতা এবং দমননীতির বিপরীতে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ। একইসঙ্গে লক্ষণীয় বিষয় হলো— সময়ের ধারাবাহিকতা। শ্রীলঙ্কা জুলাইয়ে, বাংলাদেশ আগস্টে, নেপাল সেপ্টেম্বরে— এক মাস অন্তর অন্তর সরকার পতন। এটি কি নিছক কাকতালীয়, নাকি কোনো ডমিনো ইফেক্ট?

যদি এমন ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, তাহলে অক্টোবর মাসে দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি দেশ রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে। পাকিস্তান, মিয়ানমার কিংবা মালদ্বীপ— সব দেশেই আছে অস্থিরতার বীজ। পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন, মিয়ানমারে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন, আর মালদ্বীপে ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক নির্ভরশীলতা— সবই সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়।

পরিশেষে

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ করেছে— যেখানে জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে, সেখানেই ক্ষমতাধর শাসকের পতন অনিবার্য। বিশেষ করে জেনারেশন জেড আজকের যুগে সবচেয়ে বড় গেমচেঞ্জার হয়ে উঠেছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে হাতিয়ার বানাচ্ছে, আবার সেই মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হলে রাস্তায় নেমে আসছে।

এখন প্রশ্ন, দক্ষিণ এশিয়ার এই তরঙ্গ থামবে কোথায়? অক্টোবর কি সত্যিই নতুন কোনো সরকারের পতন দেখতে যাচ্ছে? নাকি এই ডমিনো ইফেক্ট অন্য কোনো দিকে মোড় নেবে? উত্তর সময়ই দেবে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়— তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বরকে অবহেলা করলে যে কোনো সরকারই বিপদের মুখে পড়বে।
 

Read Entire Article