সংকটে শাঁখা শিল্প, পেশা বদলাচ্ছেন কারিগররা

4 months ago 22

কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি জটিলতা ও মূলধনের অভাবসহ নানা সংকটে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে পাবনার শাঁখা শিল্প। পরিবহন ব্যয়সহ শাঁখা তৈরিতে সার্বিকভাবে ব্যয় বাড়ায় বেড়েছে শাঁখার দর। কমেছে ক্রেতার চাহিদাও। এতে দুর্দিন নেমে এসেছে শাঁখা পল্লিতে। মূলধনের অভাবে বেশিরভাগই পরিবর্তন করছেন দীর্ঘদিনের এ পেশা।

হিন্দু বিবাহিত নারীদের হাতে পরার অন্যতম অলংকার শাঁখা তৈরিতে খ্যাতি অর্জন করেছে পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ও ডেফলচড়াসহ কয়েকটি গ্রাম। পরিবারভিত্তিক এই শিল্পে এসব এলাকার পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যুক্ত রয়েছেন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলে শঙ্খ কেটে শাঁখা তৈরির কাজ। তৈরি হয় ধলা, জাজী, কড়ি, পাটি, কাঁচ চাম্বর, কাচ্ছাম, কড়ি, চোত্বা, মনিপুরী ও ভিআইপি ডিজাইনসহ নানা রকম শাঁখা। মানভেদে প্রতিটি বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়। ৫০০ টাকার একটি শাঁখা তৈরিতে খরচ হয় ৩৫০ টাকা। কখনো এর বেশিও খরচ পড়ে যায়।

কারিগররা জানান, শাঁখা তৈরির কাঁচামাল আনতে হয় ভারত থেকে। ফলে আমদানি জটিলতাসহ খরচও বেশি পড়ে যায়। দিনরাত কাজ করে শাঁখা বিক্রি করতে তাদের ছুটে যেতে হয় বিভিন্ন জেলায়। এতে বেড়ে যায় শাঁখার দাম। ফলে কমেছে ক্রেতার চাহিদা। একসময় এই পাড়ার প্রায় প্রতিটি পরিবার এই শিল্পে যুক্ত থাকলেও নানা সংকটে বর্তমানে মাত্র ৩৪টি পরিবার কোনোভাবে শাখা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সহজ শর্তে ঋণ ও উন্নত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করার দাবি জানান তারা।

সংকটে শাঁখা শিল্প, পেশা বদলাচ্ছেন কারিগররা

শাঁখারিপল্লির অন্যতম প্রবীণ কারিগর শ্রী বাবলু ধর। প্রায় চার দশক ধরে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কয়েকটি ধাপে শঙ্খ কেটে শাঁখা তৈরি করেন তিনি। এত সংকটে এখনো এ পেশায় টিকে থাকলেও শেষ অবধি টিকতে পারবেন কি-না, তা নিয়ে তার মনেও রয়েছে সংশয়।

আরও পড়ুন:

বাবুল ধর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে শাঁখা তৈরির পেশা লাভজনক ছিল। এসব পল্লির নারী-পুরুষ সবাই এ কাজ করতো। সংসারে সচ্ছলতাও ছিল। এখন এ থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে চলা যায় না। ফলে পুঁজি হারিয়েছেন অনেকে। বাজারে চাহিদাও কম। সবমিলিয়ে এ শিল্পের অবস্থা ভালো নয়।’

সংকটে শাঁখা শিল্প, পেশা বদলাচ্ছেন কারিগররা

প্রবীণ এই শাঁখারি আরও বলেন, টিকতে না পেরে অন্য পেশায় চলে গেছেন অনেকে। বাকি যারা আছেন তারাও যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।

পরিতোষ ধর নামের আরেক শাঁখারি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারত থেকে কাঁচামাল নিয়ে এসে পরিবারের সবাই মিলে শাঁখা তৈরি করি। এরপর বিক্রি করতে পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরসহ বিভিন্ন জেলার গ্রামগঞ্জে ছুটে যাই। যা লাভ হয় তা দিয়েই সন্তানের পড়াশোনাসহ সংসারের খরচ বহন করতে হয়। কিন্তু বর্তমান বাজারে এই আয়ে চলতে হিমশম খেতে হয়। সবসময় অভাব-অনটনের মধ্যে থাকতে হয়। এসবের কারণে অনেকেই এ পেশা ছেড়েছেন।’

সংকটে শাঁখা শিল্প, পেশা বদলাচ্ছেন কারিগররা

ছোটবেলায় বাবার বাড়িতে শাঁখা তৈরির কাজ শিখেছেন কারিগর নীলাবতী সেন। এখন শ্বশুরবাড়িতে এসেও এ কাজ করছেন। সন্তানদের পাশাপাশি শেখাচ্ছেন অন্যান্য নারীদেরও।

নীলাবতী সেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংসারের পাশাপাশি এই কাজ করে বাড়তি আয় করছি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নারী উদ্যেক্তা হয়ে সংসারে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবো।’

সংকটে শাঁখা শিল্প, পেশা বদলাচ্ছেন কারিগররা

শাঁখারিপল্লির মৃত্যুঞ্জয় জয় সেন, দীপ্ত সেন, অন্তু কুমার ও ষষ্ঠী সেনসহ কয়েকজন কারিগর জানান, বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী এই পেশা এখন বিলুপ্তির পথে। পরিবহন খরচ ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, পুঁজির অভাব ও বাজারে চাহিদা কম থাকায় তেমন আয় নেই। ফলে এই পেশা ছেড়ে দিনমজুরিসহ বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা। তবে সরকারি সহযোগিতা পেলে আবার ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখেন তারা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উপ-মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শামীম হোসেন বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে আমাদের কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে শাঁখা শিল্পের উদ্যোক্তারা চাইলে আমরা তাদের আর্থিক সহযোগিতা দিতে পারবো। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

এএইচআইএন/এসআর/জেআইএম

Read Entire Article