কনকের স্বপ্ন ছিল সরকারি কর্মকর্তা হওয়া। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করতেই বিয়ে দিয়ে দেন অভিভাবকেরা। তার স্বামী ছিলেন ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। সংসারে প্রবেশ করতেই ধীরে ধীরে বিবর্ণ হতে থাকে স্বপ্নগুলো। শুরু হয় কনকের গৃহিণী-জীবন।
কনকের পুরো নাম আন্দালিবুল জান্নাত। ছোটবেলা থেকে সেলাইয়ে আগ্রহ ছিল তার। সময় পেলেই সুঁইসুতা নিয়ে বসে পড়তেন। টুক টুক করে কাপড়ের ওপরে আঁকতেন ফুল, পাখি, গ্রামের দৃশ্যসহ কত কিছু! পড়ালেখার চাপে কৈশোরের সেই বন্ধু, সুঁইসুতার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। তারপর কেটে যায় অনেক বছর। ২০১৯ সালে কনককে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। তখন আবারও তাকে ফিরতে হয় সুই-সুতার কাছে। মায়ের কাছ থেকে নেওয়া ৫ হাজার টাকায় তিনি শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা। নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গৃহিণী কনক এখন সফল উদ্যোক্তা।
কনকের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলা সদরের কুঠিবাড়ি গ্রামে। একজন নারী হিসেবে উদ্যোক্তা হওয়ার পথটা তার সহজ ছিল না। এমনকি এক ছেলে, দুই মেয়ের সংসার নিয়ে এখনও সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে তাকে। সহযোগিতা পেয়েছেন মায়ের, আর ছায়ার মতো পাশে ছিলেন স্বামী আতিকুর রহমান।

শুরুর গল্পটা বলতে গিয়ে কনক বললেন, ‘২০১৯ সালে শখের বসে শুরু করি। তখন টুকটাক অর্ডার আসতো। একাই করতাম সেগুলো। ২০২০ সালে করোনা শুরু হলে স্বামী বেকার হয়ে যান। সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। মেয়েটা তখনও ছোট। তখন স্বামীর পরামর্শে সুঁই-সুতার কাজে ঝুঁকে পড়ি। শুরুতে কুশিকাটার সোয়েটার, ফ্রক, টুপি, টেবিল রানার, মেট বানাতে শুরু করলাম। একপর্যায়ে কুশিকাটার অর্ডার বেশি আসতে শুরু করে।’ কনক জানান, তখনই তার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘অহন বুটিকস’-এর যাত্রা শুরু হয়।
অহন বুটিকসের কর্মীদের হাতে তৈরি কাটওয়ার্ক ও এপ্লিকের কাজের মধ্যে রয়েছে বেড কভার, থ্রি পিস, বাচ্চাদের ড্রেস, কুশন কভার এবং কুশিকাটার কাজের ভেতর রয়েছে টেবিল রানার সেট, কুশন কভার, বেড কভার, পর্দা, শীতের শাল, সোয়েটার, টেবিল কভার, চেয়ার কভার, ডিফ ফ্রিজ কভার, ওভেন কভার, মেয়েদের জন্য ডিজাইন করা কুর্তি ইত্যাদি। মজুরি ও খরচ মিটিয়ে মাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাভ থাকে প্রতিষ্ঠানটির। তাদের পণ্য বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে। পাশাপাশি বিদেশেও চাহিদা আছে এসবের।
কনক শুধু নিজে স্বাবলম্বী হননি, পাশাপাশি গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত বেকার নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার অহন বুটিকসে প্রায় ২০০ নারী বিনামূল্যে সেলাই ও হাতের কাজ শিখেছেন। তাদের অনেকেই এখন নিজেদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। অহন বুটিকসে যারা কাজ করেন, তারাও কনকের কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অহন বুটিকসে এখন কর্মরত প্রায় ১৫০ জন কর্মী। তাদের মধ্যে ফাতেমা খাতুন, আয়সা আকতার, সাবিনা ইয়াসমিন ও সুখি খাতুনরা জানান, বাড়ির কাজের ফাঁকে এক এক জন ৩-৪ বছর ধরে সুঁইসুতায় বাহারি ডিজাইনের পোশাক তৈরি করেন। মাসে আয় করেন ৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এই টাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও নিজেদের খরচ চালানোর পাশাপাশি স্বামীকেও সহযোগিতা করেন অনেকে। ফাতেমা বলেন, ‘এই কাজের মাধ্যমে আমরা আর্থিকভাবে অনেকটা স্বচ্ছল হয়েছি।’

অহন বুটিকসকে অনেক দূর নিয়ে যেতে চান কনক। তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠান আমার সন্তান। সন্তানকে নিয়ে সবার একটা স্বপ্ন থাকে। আমি আমার পেইজ “অহন বুটিকস”কে একটা দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করাতে চাই। সেই লক্ষ্যে কর্মীদের নিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে কাজ শিখতে আসা মেয়েদের সব সময় বলি, আপনারা কারও দয়া বা করুণায় চলবেন না। সবাই নিজেদের উপার্জনে চলবেন। সেলাই কিংবা হাতের কাজ করলে বাড়িতে বসেই অনেক টাকা আয় করা যায়। গ্রামের অনেক মেয়ের অনেক প্রতিভা ও মেধা আছে। আমি চাই, এই মেয়েরা ফোনে সময় নষ্ট না করে নিজের মেধা কাজে লাগিয়ে ভালো কিছু করুক এবং স্বাবলম্বী হোক।’
এলবি/আরএমডি

3 hours ago
2









English (US) ·