সংস্কারের ফল পেতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হবে

1 month ago 9

গত এক বছরের অর্থনৈতিক সময়চক্রে সরকার স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিলেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি আসেনি। মুদ্রানীতি, নীতিগত অনিশ্চয়তা, কর সংগ্রহে বাধা ও প্রাইভেট সেক্টরের অনাগ্রহ প্রধান ভূমিকা রেখেছে অনুঘটক হিসেবে। সরকারের নেওয়া সংস্কার ও পদক্ষেপের ফল পেতে ভবিষ্যতে মুদ্রানীতি ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে, ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে হবে এবং রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের সংস্কার অব্যাহত রেখে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে। এসব পদক্ষেপ সফল হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন।

গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল্যায়ন নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা ইব্রাহীম হুসাইন অভি

জাগো নিউজ: অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো। জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিশেষ করে আর্থিক খাতের সংস্কার, কর্মসংস্থান, বৈষম্য হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার, তার কতটুকু অর্জিত হলো?

মোস্তাফিজুর রহমান: বর্তমান সরকার এমন এক সময় শাসনভার গ্রহণ করেছে যখন অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, ঋণখেলাপি, বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থানের সংকট এবং সুশাসনের ঘাটতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। এক বছরের সময় খুব দীর্ঘ নয়, তাই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে—এমন প্রত্যাশা করা বাস্তবসম্মত নয়। তবু এই সময়ে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে বোর্ডের কাঠামো সংস্কার, সম্পদ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ এবং শেয়ার মার্কেটে নতুন ইস্যু আনার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বহিঃখাতকে স্থিতিশীল করতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও টাকার মান কিছুটা স্থিতিশীল করা হয়েছে। অর্থনৈতিক তথ্য ও পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা হয়েছে এবং ব্যাংক খাতের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতিনির্ধারণে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অগ্রগতি আসেনি এবং প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগও এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। গত কয়েক বছরে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, যা অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাগো নিউজ: বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে কেন কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি আসেনি?

মোস্তাফিজুর রহমান: মূলত মুদ্রানীতি এবং বিনিয়োগের মধ্যে টানাপোড়েনের কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর মুদ্রানীতি নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার প্রভাব বিনিয়োগে নেতিবাচক পড়েছে। আমরা এখনও মুদ্রানীতিকে প্রধানত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালনা করছি। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্তভাবে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আরেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো প্রাইভেট সেক্টরের অনিশ্চয়তা, যেখানে সুদের হার বেশি, প্রশাসনিক জটিলতা ও নীতি পরিবর্তনের ঝুঁকি বিনিয়োগের উৎসাহ কমিয়েছে। এ কারণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়নি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়নি। এছাড়া গত কয়েক বছরে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদাও তেমন বাড়েনি, যা বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

জাগো নিউজ: আপনার মতে, আগামীতে কোন দিকগুলোয় জোর দেওয়া প্রয়োজন?

মোস্তাফিজুর রহমান: প্রথমত, মুদ্রানীতি এবং অর্থনৈতিক নীতিতে ভারসাম্য আনতে হবে যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। প্রাইভেট সেক্টরের আস্থা পুনরুদ্ধার ও তাদের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে প্রশাসনিক জটিলতা কমানো, কর ব্যবস্থা সহজতর করা এবং নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করাও অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কর প্রশাসনের আধুনিকায়ন এবং করভিত্তি সম্প্রসারণ জরুরি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য শিল্প, এসএমই এবং রপ্তানিমুখী খাতকে আরও উৎসাহিত করতে হবে। সবশেষে, অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন ও জবাবদিহি জোরদার করতে হবে, যাতে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

জাগো নিউজ: সরকারি রাজস্ব আহরণ ও ডেট সার্ভিসিং নিয়ে আপনার কী মতামত?

মোস্তাফিজুর রহমান: রাজস্ব সংগ্রহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটজনক বিষয়। আমরা আশা করেছিলাম যে সরকারের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পাবে, যা ডোমেস্টিক ও ফরেন ডেট সার্ভিসিংয়ের ওপর নির্ভরতা কমাবে। এনবিআরের সংস্কার হয়েছে, কিন্তু প্রত্যাশিত গতি পায়নি। এই দুর্বলতা অর্থায়ন বাড়াতে ব্যর্থতার প্রধান কারণ। পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি উন্নত করতে হলে আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এজন্য রাজস্ব আহরণ বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে সংস্কারের ধারাবাহিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকারও এই কাজ অব্যাহত রাখতে পারে।

জাগো নিউজ: ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারের কী ধরনের সহায়তা বা পরিবেশ দরকার?

মোস্তাফিজুর রহমান: প্রাইভেট সেক্টর ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই ব্যবসায়ীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এর মধ্যে ভোকেশনাল ট্রেনিং, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং কস্ট অব বিজনেস কমানো অন্যতম। শুধু ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো যথেষ্ট নয়, ব্যবসার অন্যান্য খরচও কমাতে হবে। এছাড়া লজিস্টিক্স, পোর্ট টার্ন অ্যারাউন্ড, সিঙ্গেল উইন্ডো সার্ভিসসহ ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও সহজতর করতে হবে। বিশ্ববাজারের পরিবর্তনশীল পরিবেশে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানোও জরুরি।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন বা উন্নতি হয়েছে?

মোস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশেষ করে চীন ও ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নশীল সম্পর্ক রয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর চীন আমাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বিভিন্ন বাধা দূর করার প্রয়াস চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা চলছে। যদিও এক বছরে সব কিছু সমাধান সম্ভব নয়, তবে এসব পদক্ষেপ ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবে।

জাগো নিউজ: ব্যাংকিং খাতে গৃহীত সংস্কারগুলো কতটা সফল হয়েছে এবং এগুলো ধরে রাখতে কী করা উচিত?

মোস্তাফিজুর রহমান: ব্যাংকিং খাতে যে সংস্কার শুরু হয়েছে তা অনেকদূর এগিয়েছে। বোর্ডের কাঠামো পুনর্গঠন, অ্যাসেট রিকভারি উদ্যোগ, ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ ইতিবাচক। তবে এটি ধরে রাখতে হলে ব্যাংক কোম্পানি আইনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য আইনি সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। সেন্ট্রাল ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং রাজনৈতিক সংস্থাগুলোর সমর্থন আদায় করাও অপরিহার্য। ট্রান্সপারেন্সি ও অ্যাকাউন্টেবিলিটি বৃদ্ধির মাধ্যমে খেলাপি ঋণের প্রবণতাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

আইএইচও/এমএমএআর/এমএস

Read Entire Article