বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর জন্ম লাভ করিয়া ৫৩ বছর অতিক্রান্ত করিয়া ৫৪ বৎসরে উপনীত হইয়াছে। উচ্চতর বাক্যবিন্যাস, চমৎকার শব্দচয়ন, বিলেতি পোষাক, অঙ্গসজ্বা, কৃত্রিম চাকচিক্যে জন্ম মূহূর্তে-প্রথম দেখায় তাহাকে অতি জ্ঞানী পণ্ডিত মনে হইলেও তাহার বালখিল্যতা, অসারতা- পাশ্চাত্যের সাদাদের লেটনাইট পার্টিতে বিয়ারের সহিত পানি মিশ্রিত করিয়া পানরত হঠাৎ করিয়া ঢ়ুকিয়া পরা তামাটে বর্ণের রবাহুতের মত অতিদ্রুত প্রকাশ হইয়া পরে। ফলত: সংবিধানের বয়স ৫৪ বৎসর হইলেও জন্মগত জটিলতা, মনবৈকল্যের রংঢ়ং, ত্রুটির সহিত বহুবিধ সমস্যায় তাহার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় নাই। তাহাকে শিশুকাল হইতেই প্রায়শই জটিল জটিল সার্জারীর সম্মুখীন হইতে হয় সেসকল অস্ত্রপাচারও বহুরূপী ইচ্ছাধারী ধাত্রী দ্ধারা সম্পন্ন হওয়ায় সে কখনোই মানবিক রুপ পায় নাই পরিনামে সে-হইয়াছে কখনও ভয়ংকর দানব কখনও বা সহজে মানুষ শিকারের মাধ্যমে টিকিয়া থাকা বুড়ো, অপাংক্তেয় মানবখেকো বাঘ। তাহার ‘উপসংহারের’ শুরু জন্ম হইতেই তথাপি যাহারা জন্মদাতা তাহাদের আত্মঅহমিকা অথবা অযথা পাণ্ডিত্য দেখানোর বেহুদা কারনে ‘সংহার’ না হইয়া জন্ম কালে আহা কি অপূর্ব সুন্দর ছিল তাহা ভাবিতে জনগনকে বাধ্য করাইবার একখানা নিম্নস্তরের যাত্রাপালা প্রতিনিয়ত মঞ্চস্ত হইয়াছে।
পাকিস্তানী মিলিটারির হাতে সকল ধর্ম সকল বর্ন, সকল মতপথের লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী আদম সন্তানের করুন নির্মম মৃত্যু, প্রায় কোটির মত বাংলাদেশী শরনার্থীর ভিটেবাড়ী হইতে দেশান্তরী হওয়া, ক্ষুধা, অর্ধাহার, অনাহার পানীয় জলের অভাবে পথে ঘাটে মৃত্যু, শরনার্থী শিবিরে চরম অব্যবস্থাপনা, অসাস্থ্যকর পরিবেশ, মানবিক বিপর্যয়, জলের মধ্যে মলমূত্র ত্যাগ আর তৃষ্ণা নিবারনের জন্য সেই জলপানহেতু কলিকাতা, বনগাঁও ত্রিপুরার শরনার্থী শিবির সহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় কাতারে কাতারে বাংলাদেশীদের কলেরায় মৃত্যু, মৃতের সৎকার না করিতে পারার কষ্ট, পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংশতা, খুন, ধর্ষন, বর্বরতার মধ্যেও সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ভিত্তিতে দরদী মানবিক সমাজ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে যে রাষ্ট্রের সংবিধানের ভ্রুণ তৈয়ার হইয়াছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন হইবার ১ মাসেরও কম সময়ের মধ্যেই ১৯৭২ সালের ১১ই জানুয়ারী তাহা অবৈধ গর্ভপাতের মাধ্যমে হত্যা করা হয় এবং পুনরায় জঠরে এক অসুস্থ্য ক্লোন টেস্টটিউব ভ্রুণ তৈয়ার করিয়া বাংলাদেশের মাতৃ-জঠরে স্থাপন করা হয়। একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবেনা যে যাহার ফলশ্রুতিতেই আজিকার বাংলাদেশের সংবিধান সঙের বিধানে পরিনত হইয়াছে।
সাময়িক সংবিধান প্রনয়ন ও নেতার রুপান্তর :
১০ জানুয়ারী, ১৯৭২। তৎকালীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু (যদিও তিনি তারপরের দিনই ‘বঙ্গবন্ধু’ হইতে ‘বঙ্গশাসকে’ পরিনত হন -যাহা একান্তই লেখকের মতামত) শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে আসিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পুর সময়ে তিনি ছিলেন পাকিস্তান কারাগারে বন্দী। দেশ স্বাধীন হইবার পরে ডিসেম্বর ২৬ তারিখে তিনি পাকিস্তান কারাগার হইতে মুক্তি পাইয়া পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রীয় বাংলোতে অবস্থান করেন সেই সময় হইতে ১০জানুয়ারী দেশে আসার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত তাহার সঙ্গী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভায় যিনি আইনমন্ত্রী হন। ১৯৭২ সনের ১০ই জানুয়ারী তিনি দেশে ফেরত আসিবার পূর্বে তাহারা উভয়ে সিদ্ধান্ত লইয়া ফেলেন যে নতুন দেশ প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থায় পরিচালিত করিবেন (বাংলাদেশ কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস- ড. কামাল হোসেন)। দূর্ভাগ্যজনক হইলেও সত্যি যে এই সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ রুপে স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত কেননা তাহারা উভয়ে কেবল যে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নাই তাহাই নহে বরং তাহারা যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের জনগনের সম্মিলিত ঐক্যেকেও অবজ্ঞা অবহেলা করিয়াছিলেন। সাড়ে সাতকোটি বাংলাদেশী জনগন ১৯৭১ সালে অবর্ননীয় কষ্ট বেদনার মৃত্যু উপত্যকায় শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করিয়া কেবলযে পাকিস্তানিদের পরাজিত করিয়াছিল তাহাই নহে বরঞ্চ সকল জনগন মনস্তাত্বিক ভাবে বিপ্লবী চেতনায় উজ্বীবিত হইয়া গিয়াছিল আর সেইকারনেই জন্ম নেওয়া নতুন দেশের শাসন ব্যবস্থা কিরুপ হইবে তাহার সিদ্ধান্ত সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ কারী সকল মত ও পথের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতেই না লইয়া এক বা দুই জনের সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দেওয়া সম্পূর্ণ রুপে অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী মনোভাবেরই ছিল পরিস্কার প্রতিফলন। শেখ মুজিবুর রহমান দেশে আসিয়াই সেই সিদ্ধান্ত অতিদ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অগ্রসর হইলেন। তিনি বুঝিতে চাহিলেন না কিংবা পারিলেন না তিনি যখন পাকিস্তান সরকারের দেশদ্রোহীতার দায় হইতে বাঁচিবার লক্ষ্যে তাহার নিজ পছন্দের আইনজীবী এ.কে. ব্রোহীকে (নিউইয়র্ক টাইমস ২১ অগাষ্ট ১৯৭১) নিয়োগ করিতে পারিবেন কি-না তাহা লইয়া অতিশয় চিন্তাগ্রস্ত তখন দেশে একখানা সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত হইয়া গিয়াছে, তাহার অবর্তমানে সম্পূর্ন ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের জনগন তর্কাতীত সফল সরকার গঠন করিয়া তাহাদের অধীনে নিজ নিজ তাগিদে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করিয়া নিজ রক্ত, সম্ভ্রম, সম্পদের বিনিময়ে পাকিস্তান মিলিটারীকে নাকানি চুবানি খাওয়াইয়া একটা গোটা দেশ স্বাধীন করিয়া ফেলাইয়াছে এবং সেই সফল সরকারের রাষ্ট্রপতি স্বয়ং তিনি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করিয়াও!! তিনি বুঝিতে অক্ষম যে যুদ্ধকালীন সময়ে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক সহ বাংলাদেশের সকল পেশার সকল শ্রেনীর সাধারন মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া রনাঙ্গনে যুদ্ধ করিয়াছে, যোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়াছে আহার যোগাইয়াছে অথবা কোন অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারের সমব্যাথী হইয়া নিরাপত্তা দিয়াছে, পদে পদে বিপদ হইতে পারে বুঝিয়াও নিজ নিজ গৃহে স্থান দিয়াছে তাই কেবল নিজ দলের নেতা নয় সকল মতপথের লোকজন লইয়াই দরকার বিপ্লবী জাতীয় সরকার। তিনি বুঝিতে অক্ষম হইলেন যুদ্ধে কেবল তাহার দলের কর্মী নয় পুরো বাংলাদেশীরাই কোন না কোন কাঠামোয় জড়িত, তিনি বুঝিতে চাহিলেন না প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার, রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার লইয়া জনগন মোটেও চিন্তিত নয় জনগন চাহে সকলকে লইয়া ইনসাফ সাম্য যথাযথ মর্যদার ভিত্তিতে মানবিক সমাজ দেশ গঠন।
প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক শেখ মুজিবুর রহমান কি তবে বোকা ছিলেন? তাইবা কিভাবে সম্ভব তিনিতো উল্টো বোকা বানাইয়াছিলেন পাকিস্তানের মাথামোটা জেনারেলদের। তাই তিনি অবশ্যই বুঝিতে পারিয়াছিলেন ঐসকল সমস্ত বিষয়। তিনি ইহাও জানিতেন যে কার্যকরী সংসদ বিহীন ওয়েষ্ট মিনিষ্টার ধাঁচের প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার শুনিতে যতই মধুর লাগুক না কেন মূলত একজনের শাসন হয় সংসদীয় একনায়কতন্ত্র হয় কোন জবাবদিহি থাকেনা আর তখনতো কার্যকরীতো দুরকিবাত কোন সংসদের অস্তিত্বও নাই তাই তিনি সজ্ঞানে তা-ই চাহিয়াছিলেন! তিনি আরও জানিতেন তার অবর্তমানে তাজউদ্দিন আহমদরা সরকারকে নেতৃত্ব দিয়া দেশ স্বাধীন করিয়াছেন তাই তার সকলের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন প্রয়োজন। নেতার প্রয়োজন বুঝিয়া তাহার সঙের বিধান তৈয়ার করিবার আইনজীবী ধাত্রীগন অতি দ্রুত পদ্ধতি বাতলাইলেন। ১১ জানুয়ারী ১৯৭২ সনে করিলেন এক অদ্ভুত আজব নজিরবিহীন সাময়িক সংবিধান। ১২ জানুয়ারী ১৯৭২ বাংলাদেশের নেতা পিতা হইয়া আগমনের মাত্র কয়েক ঘন্টার ভিতরেই বঙ্গভবনে চলিল এক আজব পরিকল্পিত সার্কাস (যদিও নিন্দুকেরা আড়ালে আবদালে বলাবলি করেন যাহার তুলনা চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডের ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের বিচিত্রানুষ্ঠানের প্রিন্সেসের নাচের সাথে তুলনীয়)। চলিল শপথ-পদত্যাগ আর শপথের এক শ্বাসরুদ্ধকর নাটিকা। নেতা সাময়িক সংবিধানের আলোকে হইলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। ৬৯ এর বঙ্গবন্ধু ৭১ এর জাতির পিতা ৭২ এর ১২ জানুয়ারী সাময়িক সংবিধানের বদৌলতে রুপান্তরিত হইলেন ক্ষমতালিপ্সু একনায়ক শাসকে বিলেত ফেরত যুদ্ধ যাইবার সাহসের অভাবে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে চলিয়া যাওয়া এলিট মাথায় বাড়ি খাইয়া জ্ঞান হারাইলো গণমানুষের বিপ্লব বেহাত হইল জনগনের আকাঙ্খা প্রত্যাশা অভিপ্রায়। মুষ্টিমেয় কতিপয় স্বার্থান্বেসী মানুষের খপ্পরে পরিল গোটা দেশ ও জাতী।
ক্লোন টেস্টিউব সঙ-বিধানের পথে যাত্রা:
সাময়িক সংবিধানে পরিস্কার ভাবে লিপিবদ্ধ ছিল গনপরিষদ বা কন্সটিটুয়েন্ট এসেম্বলি ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের, ১৯৭১ এর জানুয়ারি এবং মার্চ মাসে জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনী আসনসমুহে বাংলাদেশের জনগন কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দকে লইয়া গঠিত হইবে এবং যাহারা অপর কোনভাবে বা আইন দ্ধারা অযোগ্য ঘোষিত হন নাই। যদিও গনপরিষদ কাহাদের দ্ধারা গঠিত হইবে তাহা লইয়া রাজনৈতিক দল সমুহের মধ্যে পূর্ব হইতেই মতভেদ ছিল কেননা ঐসকল নির্বাচনে জনগনের ম্যান্ডেট ছিল ৬দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ইত্যবসরে দেশযে কেবল স্বাধীন হইয়াছে তাহাই নহে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে দেশে ব্যপক গুনগত মৌলিক পরিবর্তন স্বাধিত হইয়া গিয়াছে তাহাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের জনগনের ইস্পাত দৃঢ় মনোবল বিপদে বন্ধু চিনিবার দিব্যদৃষ্টি অর্জনের মাধ্যমে যে উচ্চতর জন আকাঙ্খা ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটিয়াছিল তাহার জন্য নতুন গনপরিষদ নির্বাচন ছিল খুবই ন্যায়সঙ্গত যৌক্তিক দাবী। এ বিষয়ে সাবেক দুই ছাত্রলীগ নেতা শাহজাহান সিরাজ ও আ.স.ম. আবদুর রবের যৌঝ বিবৃতি প্রনিধান যোগ্য তাহারা ১৯৭২ সালের ৬ অক্টোবর এক বিবৃতিতে বলেন ‘পরিষদ-সদস্যের শতকরা নব্বই জনই যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত না থেকে আরাম আয়েসে গা ভাসিয়ে দিয়ে এবং নানা ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সম্পূর্ণ সময়টুকু ভারতে নির্লিপ্ত জীবন যাপন করেছে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশের শাসনতন্ত্র প্রনয়নের অধিকার সেই সব গনপরিষদ সদস্যের আদৌ আছে বলে দেশবাসী মনে করেনা’। কিন্তু মাত্র ১বছর পূর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার যুক্তি দেখাইয়া সবকিছুই পাস কাটাইয়া লওয়া হয় কেননা সাময়িক সংবিধানের সংজ্ঞা মতে গনপরিষদে আওয়ামী লীগ অনুসারীদের ছিল জয়জয়কার। যদিও ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ডিসেম্বর ১৯৭০ হইতে জানুয়ারী ১৯৭১ সন পর্যন্ত নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগন দ্ধারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের লইয়া গনপরিষদ গঠন করিয়াছিল এবং সেই গনপরিষদ বাংলাদেশের জনগনের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে পারস্পরিক আলোচনা করিয়া সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররুপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিয়াছিল তথাপি উহাতে আরও লিপিবদ্ধ ছিল ‘আমরা বাংলাদেশের জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিগন আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, কোন কারনে রাষ্ট্রপতি না থাকা বা রাষ্ট্রপতি তাহার কার্যভার গ্রহণ করিতে অসমর্থ হওয়া বা তাহার ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে অসমর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রপতির উপর এতদ্ধারা অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপ-রাস্ট্রপতির থাকিবে এবং তিনি উহা প্রয়োগ ও পালন করিবেন’। এই ঘোষণামূলেই জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ লইয়াছিলেন বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল। পরবর্তীতে যুদ্ধকালে এবং দেশ স্বাধীন হইবার পরে ১১জানুয়ারী ১৯৭২ সালের আগ পর্যন্ত সকল আদেশ অধ্যাদেশে সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামের পরে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বা একটিং প্রেসিডেন্ট লিপিবদ্ধ থাকিত। অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রপতি দেশে আসিয়া শপথ গ্রহনের আগমূহূর্ত পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি অথচ ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাময়িক সংবিধান আদেশ শেখ মুজিবুর রহমান ‘রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে জারী করিয়াছিলেন শপথ ব্যতিরেকে স্বৈরাচারী কায়দায়! এমনকি গণপরিষদের সভ্যদের মতামত নেওয়াতো দূরের কথা কোন সভা আহ্বান ব্যতিরেকেই তিনি সাময়িক সংবিধান আদেশ দিয়াছিলেন অথচ স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র প্রতিটি বাক্য প্রতিটি শব্দ সকলের মতামতের ভিত্তিতেই লিখিত হইয়াছিল। তদুপরি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ লইবার পূর্বে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আদেশ প্রদান অযৌক্তিক ন্যায়সঙ্গত নয় এবং বৈধ নয় তাহা কেন তাহার আইনজীবি সতীর্থগন বলিলেন না তাহা বিস্ময়কর। ফলশ্রুতিতে, বড় অঘটনটি ঘটে তাহার পরেরদিন ১২ই জানুয়ারীতে যেই দিন শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়া অতঃপর পুনরায় নিজে রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ লইয়া আবার রাষ্ট্রপতি হইতে পদত্যাগ করিয়া প্রধানমন্ত্রী হইলেন। ঐ দিনের ঘটনা প্রবাহ লইয়া এইচ টি ইমাম ২০১৪ সালের ১৮ এপ্রিল দৈনিক সমকালে লেখেন ‘রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েমকে সাময়িক সংবিধান আদেশের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ করেন। প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে শপথ বাক্য পাঠ করান এরপরেই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ ঘোষনার পর, সাময়িক সংবিধান আদেশের ৮নং ধারাবলে মন্ত্রীপরিষদের সিদ্ধান্ত ক্রমে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দান করা হয়। অতঃপর প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করান। এরপর রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। বিকেলে তাজউদ্দিন আহমদ ও মন্ত্রী সভার সদস্যরা পদত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খবর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হলঘরে উপস্থিত সবাই মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি করে উল্লাস করে।’ আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টিকে একেবারে নিরীহ শপথ অনুষ্ঠান মনে হইলেও মনযোগ দিয়া পড়িলে ব্যপক অসঙ্গতি চোখে পরিবে। প্রথমত:-সাময়িক সংবিধান আদেশের ৩নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইহা ১১ জানুয়ারি হইতে বলবৎ এবং রাষ্ট্রপতি সেই ক্ষমতা বলেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করেন।ধরিয়া লইতে হইবে তিনি তাহার পূর্বেই রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্ত ১১ তারিখের পূর্বে তাহার রাষ্ট্রপতি হিসেবে কার্যভার গ্রহণ, কিংবা শপথের দালিলিক কিংবা ঐতিহাসিক প্রমান নাই। দ্বিতীয়ত: প্রধান বিচারপতি পুনরায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়োগ দিলেন। যদি তিনি রাষ্ট্রপতি থাকেনই তাহলে কেন তাকে আবার শপথ বাক্য পাঠ করাইতে হইল বোধগম্য নয়। ধরিয়া লইতে হইবে স্বাধীনতার ঘোষনা পত্রের অধীন তিনি শপথ লইয়াছেন কিংবা সাময়িক সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টকে শপথ পড়াইয়াছেন। যদি ঘোষনা পত্রের অধীন শপথ লইয়া থাকে তাহা হইলে সাময়িক সংবিধান বাতিল কেননা তাহা হইলে তাহার (শেখ মুজিবুর রহমানের) সাময়িক সংবিধান আদেশ জারী করিবার কোন এখতিয়ার থাকে না সেক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির নিয়োগও বেআইনী আবার যদি সাময়িক সংবিধানের আলোকে হয় তাহলে শপথ কেন লইতে হইবে? তাহাতো তিনিই আদেশ মুলে করিয়াছিলেন। তৃতীয়ত: রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করিলেন এবং ৮ নং অনুচ্ছেদ বলে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আরেক বিচারপতি রাষ্ট্রপতি হইলেন। মন্ত্রীপরিষদ কখন কিভাবে সিদ্ধান্ত লইল তাহার কোন বর্ননা নাই ধরিয়া লইতে হইবে যুদ্ধকালীন মন্ত্রী সভা বহাল রহিয়াছে এবং তাহারা শপথ আর পদত্যাগের নাটকের আগেই এই সিদ্ধান্ত লইয়াছেন। তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি বর্তমান থাকা অবস্থায় তাহারা কিভাবে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের সিদ্ধান্ত লইল? আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হইতেছে অনেক কিছু ধরিয়া লইলেও নিয়োগ হইতেছে সাময়িক সংবিধান মোতাবেক তখন ঐ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী একজন প্রধানমন্ত্রী ও কেবিনেট লাগিবে তাহারাই সিদ্ধান্ত লইবেন রাষ্ট্রপতি কে হইবেন। সেই কেবিনেট গঠনতো হইলো শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হইবার পরে! হযবরল, লেজে গোবরে বাক্য বা শব্দ কেন আসিয়াছে বাংলায় ইহার চাইতে উত্তম উদাহরণ আর কিই-বা হইতে পারে! চতুর্থত: উপ-রাষ্ট্রপতির কি হইবে তাহাও নাই সাময়িক সংবিধানে। তিনি কি পদত্যাগ করিয়াছিলেন? কখন করিলেন কিংবা কাহার নিকট কোন বিধানে তাহাও এক বিরাট ধাধা। স্বাধীনতার ঘোষনা পত্রে পরিষ্কার উল্লেখিত রহিয়াছে সংবিধান প্রনীত হওয়ার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপতি থাকিবেন!! অথচ: সাময়িক সংবিধানও করা হইয়াছিল ঘোষনা পত্রের পাওয়া ক্ষমতা বলেই!সবচাইতে হাস্যকর বিষয় এইযে যে স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে উকিল বাহাদুরদের খসড়া মোতাবেক শেখ মুজিবুর রহমান এত কিছু করিলেন সেই ঘোষনা পত্রের সর্বশেষ প্যারা হয়তোবা ড্রাফট করিবার সময় চোখ এড়াইয়া গিয়াছে কেননা তাহাতে লিপিবদ্ধ "আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, এই দলিল কার্যকর করার লক্ষ্যে এবং রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে আমাদের যথাযথ ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রতিনিধি নিয়োগ করিলাম।’ রাষ্ট্রপতি দেশে ফেরত আসিবার পরে শপথ লইলেন কার কাছে তাহা উপরোক্ত আলোচনাতেই পরিষ্কার। এখন যদি কেহ বলিয়া বসে যুদ্ধকালীন গণপরিষদের সভ্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষনা পত্রের দলিল পরিপূর্ণ কার্যকর হইবার পূর্বে কোন ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রপতি সাময়িক সংবিধান করিলেন তাহার জবাব কি হইবে? অনেক পন্ডিত ব্যক্তি তাচ্ছিল্যের সহিত বলিতে পারেন সাময়িক সংবিধানের বৈধতা লইয়া ১৯৭৩ সনেই মামলা হইয়াছিল (যাহা ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতির আদেশ মূলে বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) আইনের কারনে অভিযুক্ত কতিপয় ব্যক্তি উক্ত আইন ও সাময়িক সংবিধানের বৈধতাকে তর্কিত করিয়া আনয়ন করিয়াছিলেন) এবং প্রধান বিচারপতি সায়েমের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট তাহা খারিজ করিয়া দিয়াছিল অতএব ইহা মীমাংসিত। (একেএম ফজলুল হক ও অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র ২৬ ডি. এল. আর এডি) তাহাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন যে সংবিধানের অধীনে প্রধান বিচারপতি সায়েম মহোদয় নিয়োগ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন তাহার কি কোন নৈতিক ভিত্তি ছিল এই মামলা শুনিবার? যেই ক্ষেত্রে খারিজ না করিলে তাহার নিজের নিয়োগই বাতিল হইবে। তাহা ছাড়া আইনের খুবই সরল একখান নীতি রহিয়াছে ‘Nemo judex in causa sua’ ল্যাটিন এই প্রবাতটি বাংলায় দাড়ায় ‘কেউ তার নিজের ক্ষেত্রে বিচারক নয়’ ইহা বুঝিবার জন্য কাউকে আইন বিষয়ক পন্ডিত হইবার প্রয়োজন হয় না সাধারন সুস্থ মাথার মানুষ মাত্রই তাহা বুঝিতে পারিবার কথা। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম প্রধান বিচারপতি এই সহজ নীতি বুঝিতে ব্যার্থ হইয়াছিলেন তাহা বাংলাদেশী মাত্র-ই যুগপৎ লজ্বা এবং হতাশার। তথাপি এই প্রধান বিচারপতি সায়েম মহোদয় পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে ৩রা নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ক্যু'য়ের পরে ৬ই নভেম্বর ১৯৭৫ সনে রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোস্তাক পদত্যাগ করিলে, খালেদ মোশাররফ তাহাকে প্রধান বিচারপতি হইতে সরাসরি মহামান্য প্রেসিডেন্ট করিয়া দেন এবং ২১শে এপ্রিল ১৯৭৭ পর্যন্ত অর্থ্যাৎ খালেদ মোশাররফের ক্যু ব্যার্থ এবং মৃত্যু বরনের পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার অনেককাল তিনি সেই পদে বহাল থাকেন। নির্মম পরিহাস ১৯৭৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তার আদেশেই বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) আইন রহিত করা হয়, (বাংলাদেশ গেজেট এক্সট্রা অর্ডিনারি তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৫) যে আইন বৈধ ভাবে হইয়াছিল বলিয়া তিনিই কি-না ১৯৭৩ সনে রায় দিয়াছিলেন! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজী-জার্মানির পতনের পরে কেন নাজী আমলের বেশ কিছু বিচারক-জুরিষ্টদের শাস্তি দেওয়া হইয়াছিল তাহা এই উদাহরণ দ্ধারা সহজেই অনুমেয়।
উল্লখিত কারণসমূহ ছাড়াও সাময়িক সংবিধানে দেওয়া গণপরিষদের সংজ্ঞা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না কেননা সংবিধান সভা কেবল বাংলাদেশেই গঠিত হইয়াছিল তাহাই নয় আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারত পাকিস্তান বৃটিশদের নিকট হইতে স্বাধীনতা পাইবার সময়ও উভয়দেশে সংবিধান রচনার জন্য সংবিধান সভা গঠিত হইয়াছিল। কিন্তু তাহাদের বৈধতার প্রশ্নে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নাই কেননা তাহারা ১৯৪৫-৪৬ সালে সংবিধান প্রনয়নের জন্যই জনগন হইতে ম্যান্ডেট প্রাপ্ত ছিলেন। অর্থ্যাৎ সংবিধান কারা তৈয়ার করিবেন তাহাদের জনগন জানিবেন, চিনিবেন, তাহাদের কর্ম মূল্যায়ন করিবেন তাহারপর বিবেচনা করিয়া ভোট দিয়া নির্বাচিত করিবেন ইহাই রীতি ইহাই নজীর। আইন অভিধান বা শব্দকোষে পরিষ্কারভাবে গণপরিষদের সদস্যের সংজ্ঞায় বলা হইয়াছে সংবিধান রচনা বা সংশোধনের জন্য অধিকার সম্পন্ন নির্বাচিত প্রতিনিধি হইবে গণপরিষদ সদস্য (ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড় কর্তৃক সম্পাদিত দ্য ল লেক্সিকন এবং আইন কমিশন হইতে প্রকাশিত আইন-শব্দকোষ) অতএব, ১৯৭২ এর সাময়িক সংবিধান গণপরিষদের সদস্য অর্থ্যাৎ নতুন সংবিধান কাহারা করিবেন সেই সংজ্ঞা নির্ধারন করিয়া দিয়া সর্নজন গ্রাহ্য প্রতিষ্ঠিত আইনী সংজ্ঞা, রীতি নজীরকে অবৈধভাবে অবমূল্যায়ন ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাইয়া ১৯৭১ সালে সমগ্র বাংলাদেশীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে গড়িয়া উঠা সাম্য ইনসাফ আর মানবিক মূল্যবোধের দেশ-সমাজ গঠনের জন আকাঙ্খা ও জন অভিপ্রায় কে কেবল বাধা নয় বরঞ্চ হত্যা করিয়াছিল নির্মমভাবে পদদলিত করিয়া আর তাহার মাধ্যমেই রোপিত হয় মুষ্টিমেয় পুরাতন আর স্বাধীনতা উত্তর পাকিস্তানিদের ফেলিয়া যাওয়া সম্পদ, ভারতে চোরাচালান কিংবা চুরি ডাকাতির অর্থে; নব্য হঠাৎ এলিট মানুষের স্বার্থ হাসিলের জন্য নষ্ট ভ্রষ্ট অসুস্থ্য চিন্তার নতুন সংবিধানের ভ্রূণ।
সঙ-বিধানের প্রসব:
সংবিধান প্রনয়নের জন্য নতুন গণপরিষদ নির্বাচনের নতুন ম্যান্ডেট দরকার আওয়ামী লীগ বাদে অন্যান্য ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক দল, মত পথের যৌক্তিক দাবীকে সাময়িক সংবিধান দ্ধারা রুদ্ধ করিয়াই তৎকালীন আওয়ামী সরকার ক্ষ্যান্ত হইলেন না তাহারা ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ করিলেন গণপরিষদ আদেশ এবং বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল আদেশ) সেই আইন করিয়া গণপরিষদের সভ্যদের কর্ম কিরূপ হইবে তাহাও নির্ধারন করিলেন। তাহাদের রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে সরকারের জবাবদিহিতা চাওয়াতো দূরের কথা স্বাধীন মতামত প্রদান রহিত করা হইল এক কথায় তাহাদের কর্ম হইল কেবল টেবিল চাপরাইয়া সংবিধান গ্রহন করা। সভ্যদের কেহ কেহ ইহাতে আপত্তি তুলিলে তাহাদেরকে গনপরিষদ হইতে বহিস্কার করা হইল। তাহার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয় ২৩ জন। কেননা তাহারা উক্ত আইনের ৩(১) ধারার লংঘন করিয়াছিল তাহার বর্ণনা ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে এবং উক্ত দলের সদস্যপদ লাভ করে কোন ব্যক্তি পরিষদ-সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি (ক) উক্ত দল থেকে পদত্যাগ করেন; অথবা (খ) উক্ত দল হতে বহিষ্কৃত হন; তবে তার মেয়াদকালের অসমাপ্ত সময়ের জন্য তিনি আর পরিষদ-সদস্যপদে থাকবেন না। আইনটির ৫ ধারা অনুযায়ী এই আইনের অধীনে প্রণীত কোন আদেশ বা গৃহীত কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না-অতএব চলিল সংবিধান প্রনয়নের সার্কাস! তাহাতে ৭০ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করাইয়া আক্ষরিক অর্থেই সংবিধানকে ‘সঙের বিধান’ করা হইল। বলিয়া দেওয়া হইল দলের সিদ্ধান্তের বাহিরে যাইয়া কোন সংসদ সদস্য আইনসভায় ভোট দিলে তাহার সদস্য পদ বাতিল হইবে। জন্ম লাভ হইল এক নেতা এক দেশ করিবার ব্যক্তি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার গণবিরোধী সংবিধানের, ঢাল হইয়া রহিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ!
২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তী ঘটনা:
১৯৭২ এর পরে পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলিতে যেমনি অনেক জল গড়াইয়াছে তেমনি বিগত ১৬ বৎসর বাংলাদেশীগণ প্রত্যক্ষ করিয়াছে; সংসদীয় একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আর রাস্ট্রের যুগপৎ দুঃশাসন, জবরদস্তি, ভোটডাকাতি, চুরি, লুটপাট, সন্ত্রাস, টেন্ডাররবাজি, সিন্ডিকেট, কমিশন, অবৈধ ব্যবসা, বিচারের নামে প্রহসন। দেখিয়াছে গরীবকে সর্বসান্ত করিয়া জমি দখল, বিরুদ্ধ মতকে হত্যা, গুম, খুন বা জেলে পুরিয়া রাখার মাধ্যমে জনগনকে গলা টিপিয়া রাখার নিষ্ঠুর শাসন। ফলাফলে হাজার হাজার মৃত্যু, অনেক অনেক রক্ত পাত, অঙ্গহানি আর অশ্রু বিসর্জনে ক্লান্ত, অপমানিত, ক্রুদ্ধ, নিপিড়ীত অধিকারহীনতায় ফুঁসিয়া উঠা জনগণের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়িয়া ২০২৪ সালে অগাস্ট মাসে স্বৈরাচারী আওয়ামী শাহীর রাজত্বের করুণ বিদায় হইয়াছে। বিদায়ের পূর্বক্ষণে গদী রক্ষার নিমিত্তে পতিত শেখগণ (মধ্যপ্রাচ্যের শেখ নহেন) তাহাদের সকল হায়েনাদিগকে অস্ত্রসস্ত্র গুলি বোমা সমেত নিরস্ত্র জনগণের উপর লেলাইয়া দিয়াও শেষ রক্ষা করিতে ব্যর্থ হইয়া তাহাদের সুপ্রিমো তাহার দুর্বৃত্ত নিকটাত্মীয় পরিবার পরিজন সমেত ব্যাপক ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতাপশালী মন্ত্রী, এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান, মেম্বার, বিচারপতি, আমলা এমনকি অতি ক্ষুদ্র দুর্বৃত্ত আতি পাতি নেতা সহ পলাতক দেশান্তরী, তথাপি জনগণ দেখিতেছে তাহাদের রচিত সংবিধান সিন্দাবাদের ভুতের ন্যায় রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়া রহিয়াছে। জনগণ প্রত্যক্ষ করিতেছেন ইত্যবসরে জনতার নতুন সরকার সেই ভুত তাড়াইবার নিমিত্তে সূদূর আটলান্টিকের ওপার হইতে একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে উড়াইয়া লইয়া আনিয়াছেন। জনগণ আশাবাদী হইয়াছেন কেননা বিজ্ঞানী এবং তাহার সভ্যগণ নতুন করিয়া সংবিধান প্রনয়নের কিংবা সংস্কারের দায়িত্ব লইয়া সংবিধান কিভাবে সংস্কার করা হইবে তাহা লইয়া প্রতিদিনই কখনও গোল কখনও বা উলম্ব কিংবা কখনও বা একক বিশেষজ্ঞের সহিত সৌজন্য সাক্ষাৎ- বৈঠকের মাধ্যমে সংবিধানকে গবেষণাগারে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করিতেছেন। ‘ঘ্রানেণ অর্ধ ভোজনং’ মত জনতা আশায় বুক বাধিয়াছে, সকলেই আশাবাদী এইবার কিছু এক্কান হইবেই হইবে। কেননা তাহারা মনে করিতেছেন বিজ্ঞানী মহোদয় এবং সভ্যগণ একেকজন অতি জ্ঞানী মানব। তাহারা তাহাদের অতুলনীয় মেধা এবং জ্ঞান দ্ধারা ১৮ কোটি জনসংখ্যার সকল শ্রেণীর সকল বাংলাদেশীদের চাওয়া পাওয়ার সমন্বয় সাধন করিয়া একখানা কালোত্তীর্ণ সংবিধান করিতে সক্ষম হইবেন। তথাপি কতিপয় সংশয়বাদীরা তাহাতে মোটেও আশাবাদী হইতে পারিতেছেন না তাহারা মনে করিতেছেন প্রয়াত জননেতা ইতিহাসশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান সালউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ‘মিয়া তত্ব’ না খাঁটিয়া যায়। তিনি (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী) সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগনের অবসরের বয়সের সীমা বাড়াইয়া দেওয়া বিষয়ক সংশোধন বহাল রাখিয়া জিয়াউর রহমান জমানার ৫ম আর এরশাদ আমলের ৭ম সংশোধনী বাতিলের রায়ের সমালোচনা করিয়া এক বক্তব্যে বলিয়াছিলেন ‘সোনা মিয়ার’ জায়গা রেজিস্ট্রারি হইয়া গিয়াছে ‘লাল মিয়ার’ নামে আর ‘লাল মিয়ার’ জায়গা রেজিস্ট্রারি হইয়া গিয়াছে ‘সোনা মিয়ার’ নামে। ইহা লইয়া মামলায় বিচারক রায় দিলেন এইভাবে ‘মিয়াতো’ ঠিকই আছে ‘সোনা’ কাঁটিয়া ‘লাল’ করিয়া দেও। তিনি স্বভাবগত মজাদার হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমায় বলিয়াছিলেন বিচারপতিগণ নিজেদের অবসরের সময়সীমা ঠিক রাখিলেন মানে ‘মিয়া’ টা ঠিক রাখিয়া ‘সোনা’ কে ‘লাল’ করিয়া দিলেন। সংশয়বাদীদের এই সংশয়ের যৌক্তিকতা উড়াইয়া দিবার মত নহে কেননা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পরে রাষ্ট্রপতি সংবিধান বহাল রাখিয়া সরকার পরিচালনা হইতেছে। অর্থ্যাৎ ‘শেখ হাসিনা’ কাঁটিয়া গেল ‘ড. ইউনুস’ চলিয়া আসিলেন ‘সংবিধান-রাষ্ট্রপতি’ রহিয়া গেল। মানে ‘মিয়া’ রহিয়া গেল। অথচ যেখানে গণঅভ্যুত্থান সংবিধানকে অতিক্রম করিবার কথা। সংশয়বাদীদের এই যুক্তির বিপরীতে সব চাইতে বড় অস্ত্র এই বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের মতামত। কিন্তু সেই মতামত পড়িলে আশ্চর্য হইতে হয় তাহাতে গণঅভ্যুত্থান, এত হাজার হাজার মৃত্যু শহীদ পঙ্গুত্ব বরণের জন্য একটা শব্দও লিখিত নাই। সবচাইতে বড় কথা যে আপিল বিভাগ এই মতামত দিয়াছিলেন তাহারাই আবার ছাত্র জনতার গণদাবীর মুখে পদত্যাগ করিয়া আত্মগোপনে চলিয়া গিয়াছেন। তাহা হইলে এই মতামতেরই বা কি মূল্য রহিল! তাই তাহাদের এই মতামত মূল বিষয় পাশ কাটাইয়া সহজ সমাধান ‘সোনা’ কাঁটিয়া ‘লাল’ করিয়া দেওয়ার মতই অপ্রয়োজনীয় গুরুত্বহীন বলিয়া মনে করেন সংশয়বাদীগণ। তাহাছাড়াও তাহাদের আরও কুযুক্তি রহিয়াছে তাহা হইল ১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধান প্রনয়ণের পরে আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ভারত যুক্তরাজ্য গমন করিয়াছিলেন। সেই সফরের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ভারত যুক্তরাজ্যের গনতান্ত্রিক চর্চা সাম্যক পর্যবেক্ষন করার। মাওলানা ভাষানীর ‘হক কথা’ পত্রিকায় তখন এর নিন্দা করিয়া লিখা হইয়াছিল ‘সংবিধানের ভারত যাত্রা’। বর্তমান সরকারের সংবিধান বিষয়ক কমিশনের সকলে দল বাঁধিয়া ড. কামাল হোসেনের মতিঝিল অফিসে ছুটিলেন, পরামর্শ লইতে। বর্ষীয়ান বিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ লইতেই পারেন ইহাতে আপত্তি থাকিবার যেমন কোন কারন নাই তথাপি ইহাও সত্য যুবক অবস্থায় তিনি যে সংবিধানের প্রধান ধাত্রী ছিলেন সেই সংবিধান এবং তাহা গৃহীত করার পদ্ধতি শেখ মুজিবুর রহমানকে চরম একনায়কে পরিণত হওয়া হইতে বারিত করিতে কেবল যে ব্যর্থ হইয়াছিল তাহাই নহে উল্টো সহযোগী হইয়াছিল ইহাও ঐতিহাসিক সত্য। সংশয়বাদীদের সংশয় নতুন সংবিধান ‘মতিঝিলে’ গোঁত্তা খাইয়া ‘ভারত’ অব্দি না পৌঁছায়!
পুনশ্চ :
জিনিসপত্রের সীমাহীন মূল্য, ব্যাংক লুটকারীদের কারণে গচ্ছিত রাখা সামান্য টাকা তুলিতে না পারা, রাস্তায় যানযট, সংসার চালাইতে হিমশিম খাওয়া ইত্যাদি নানাবিধ বেশুমার চাপের স্বীকার জনগণের উপর সংবিধান লইয়া সংশয় বাদীদের চাপ সামলাইবার জন্য শেফালী ঘোষের এই গান খানা টনিকের মত কাজ করিতে পারে ‘ও মানুরে ও সুন্দর মানু, কি ছবি বানাইবা তুঁই আঁই ন বুঝি, এক্কইবারে লইযাও আঁরে, আঁইতো রাজী। ও মানুরে ও সুন্দর মানু...’
লেখক : এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং ভিন্নমত পোষণের দায়ে আওয়ামী সরকারের বরখাস্তকৃত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।