সঞ্চয়পত্র কেনাবেচার আলাদা বাজার তৈরির পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, সঞ্চয়পত্র এখন বাজারের সঙ্গে আংশিক যুক্ত। কিন্তু এটিকে পুরোপুরি লেনদেনযোগ্য করতে হবে। এতে গ্রাহকরাও উপকৃত হবেন এবং সেকেন্ডারি মার্কেট তৈরি হওয়ার পাশাপাশি তারল্যও বাড়বে।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ সরকারি বন্ড কিনতে পারছে, এ বিষয়টিও ইতিবাচক। এখন বেসরকারি বন্ডও লেনদেনযোগ্য করতে হবে ও সঠিক কাঠামোর আওতায় আনতে হবে। এতে রাতারাতি বন্ড মার্কেট দ্বিগুণ হয়ে যাবে এবং বাজার অনেক প্রাণবন্ত হবে।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের বন্ড ও সুকুক বাজার উন্মোচন : রাজস্ব স্থিতি, অবকাঠামো বাস্তবায়ন ও ইসলামি মানি মার্কেট উন্নয়ন’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি একথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ অর্লিন্সের অধ্যাপক এম কবীর হাসান।সভাপতিত্ব করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান খোন্দকার রাশেদ মাকসুদ।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বন্ড কেনার ক্ষেত্রে সরকারের পেনশন-ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদি তহবিলের উৎস হতে পারে। এ ছাড়া করপোরেট পেনশন ফান্ড, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বেনেভোলেন্ট ফান্ড—এসবকেও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব। সরকার চাইলে এসব বিষয়ে খুব দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। সে জন্য পেনশন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ দরকার। সব প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে তহবিল গড়ে তুলছে, এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
গভর্নর বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক কাঠামো বৈশ্বিক অর্থনীতির তুলনায় আলাদা। এক অর্থে এটি উল্টো। বাংলাদেশে আর্থিক কাঠামো ব্যাংকনির্ভর; কিন্তু বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা মূলত বন্ডনির্ভর। বৈশ্বিকভাবে প্রায় ১৩০ ট্রিলিয়ন বা ১৩০ লাখ কোটি ডলারের বন্ড ইস্যু করা হয়েছে; এটি বৈশ্বিক জিডিপির ১৩০ শতাংশ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার হলো স্টক মার্কেট; এই বাজারে বিনিয়োগ আছে প্রায় ৯০ ট্রিলিয়ন বা ৯০ লাখ কোটি ডলার। তৃতীয়ত, মানি মার্কেট (ব্যাংক ঋণসহ সবকিছু) মোট ৬০ ট্রিলিয়ন বা ৬০ লাখ কোটি ডলারের, অর্থাৎ এটি বন্ড বাজারের অর্ধেকেরও কম। ফলে আমাদের কাঠামোটি একেবারেই উল্টো। পেনশন বা বিমা খাতের কথা বলছি-ই না, সেগুলো এতই ছোট যে বাংলাদেশে জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ গণনায় ধরার মতোও নয়। এই হলো বাস্তব চিত্র।
সুকুকের বাজার খুবই ছোট উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪ হাজার কোটি টাকার ছয়টি সুকুক ইস্যু হয়েছে। অথচ আমাদের অনেক প্রকল্প থেকে আয় হচ্ছে। সেসব সম্পদ সিকিউরিটাইজ করলে দ্রুত সুকুক বাজার বড় করা সম্ভব। যেমন যমুনা বা পদ্মা সেতু থেকে টোল আদায়ের প্রবাহ ব্যবহার করে নতুন সেতু নির্মাণে বন্ড ইস্যু করা যেতে পারে। একইভাবে মেট্রোরেল, টোল রোড, ফ্লাইওভার—এসব প্রকল্প থেকেও যে আয় হয়, তা সিকিউরিটাইজ করে নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের অর্থ জোগাড় করা সম্ভব। সে জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ কার্যকরী বিভাগ দরকার; এর কাজ হবে শুধু এই বিষয়গুলো দেখা। বর্তমানে বাংলাদেশে বিমার বাজার জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। ভারতে এটি ৪ শতাংশ—উন্নত দেশে ১২ শতাংশ। ফলে বিমা খাতের উন্নয়ন অপরিহার্য।
গভর্নর জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে বন্ড মার্কেট উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। শিগগিরই সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ তা উপস্থাপন করা হবে। সুপারিশগুলোতে বন্ড মার্কেটের বিভিন্ন খাত—কনভেনশনাল ও সুকুক (ইসলামি বন্ড) দুটোই অন্তর্ভুক্ত আছে।