গণঅভ্যুত্থান ও স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যায়। এই পরিবর্তন সারাদেশের মতো চুয়াডাঙ্গার ব্যবসা-বাণিজ্যকেও প্রভাবিত করেছে। সেসব বিষয় নিয়েই চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহসভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহারিন হক মালিকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। উঠে আসে জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সম্ভাবনার কথা।
জাগো নিউজ: চুয়াডাঙ্গার ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
শাহারিন হক মালিক: চুয়াডাঙ্গা সীমান্তঘেঁষা জেলা হওয়ায় ব্যবসার সুযোগ তুলনামূলক বেশি। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য দুর্বল হয়ে গেছে। চুয়াডাঙ্গার অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে ব্যবসায়ীদের ওপর কঠোর ও ফ্যাসিস্ট নীতি প্রয়োগ হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা চাপের মধ্যে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। জুলাই বিপ্লবের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বস্তিদায়ক হলেও এখনো ব্যবসা সম্পূর্ণ স্থিতিশীল নয়।
জাগো নিউজ: ৫ আগস্টের পর থেকে চুয়াডাঙ্গার ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কেমন?
শাহারিন হক মালিক: সারা দেশের মতো চুয়াডাঙ্গাতেও ব্যবসা কার্যত স্থবির। দর্শনা ল্যান্ডপোর্ট থেকে যে পণ্য আসত, তা আপাতত বন্ধ। কোনো মালই ল্যান্ডপোর্টে আসছে না। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ব্যবসায়ীদের চিন্তায় ফেলেছে।
জাগো নিউজ: ৫ আগস্টের পর এখন পর্যন্ত কোনো চাপ এসেছে কি না?
শাহারিন হক মালিক: আমাদের কোনো চাপ আসেনি। বরং ফ্যাসিস্টদের বিদায়ের পর বিএনপি-জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা পেয়েছি।
- আরও পড়ুন-
- ‘আম-চিংড়ির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দরকার প্রসেসিং জোন’
- শিগগির অগ্রণী ব্যাংক খেলাপিমুক্ত হয়ে আগের মর্যাদায় ফিরবে
- পারমানেন্ট জবের জন্য বিসিএস দিলাম: এনামুল
জাগো নিউজ: চুয়াডাঙ্গার ব্যবসায়ীরা কোনো চাঁদাবাজির শিকার হয়েছে কি না?
শাহারিন হক মালিক: আমি নিজেই ব্যবসায়ী। আমার কাছে কেউ কোনো চাঁদা চাইনি। আমার জানামতে আমিসহ কোনো ব্যবসায়ীই কোনো চাঁদাবাজির শিকার হননি। তবে সার্বিকভাবে ব্যবসায়ীক মন্দা আছে।
জাগো নিউজ: উদ্যোক্তাদের এখন প্রধান সমস্যা কী?
শাহারিন হক মালিক: সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পর্যাপ্ত অর্থায়ন না পাওয়া। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাচ্ছেন না। সীমিত অবকাঠামো, অনিশ্চিত সবকিছু ব্যবসার গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। শুধু চুয়াডাঙ্গা নয়, সারাদেশেই একই পরিস্থিতি। আর চুয়াডাঙ্গায় তো গ্যাস সরবরাহই নেই।
জাগো নিউজ: এসব সমস্যা সমাধানে চেম্বারের উদ্যোগ কী?
শাহারিন হক মালিক: আমরা সরকারি দপ্তরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে সমস্যাগুলো জানাই। ঋণপ্রাপ্তি সহজ করার জন্য স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে তাদের হেড অফিসে কথা বলার জন্য আমরা বলেছি। এছাড়া উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সবরকম সহযোগিতা আমরা করতে প্রস্তুত। এমনকি চেম্বারের পক্ষ থেকে করাও হয়।
জাগো নিউজ: চেম্বারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা কেমন?
শাহারিন হক মালিক: আমাদের সরাসরি সহযোগিতার সুযোগ সীমিত। কেউ যদি আসে, আমরা চেষ্টা করি তাকে সাহায্য করার। তবে সরকারের কার্যকারিতা না থাকায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জাগো নিউজ: চুয়াডাঙ্গায় কোন খাতে বিনিয়োগের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে?
শাহারিন হক মালিক: কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প, হিমাগার, খাদ্য প্রসেসিং, চামড়া ও বস্ত্রশিল্পে বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। সীমান্ত জেলা হওয়ায় ও রেল বন্দর থাকায় আমদানি-রপ্তানিতেও বিরাট সুযোগ আছে। এছাড়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হলে বিদেশি বিনিয়োগও এখানে আসতে পারে।
জাগো নিউজ: চুয়াডাঙ্গায় বিসিক শিল্পনগরী বাস্তবায়ন হওয়ার পর থেকে কি উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধা তৈরি হয়েছে?
শাহারিন হক মালিক: দুঃখের বিষয়, বাস্তবে উদ্যোক্তাদের সুবিধা খুবই সীমিত। ২০২১ সালে চুয়াডাঙ্গা সদরের ডিঙ্গেদহে ১২ একর জমিতে শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়। কিন্তু প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় দেরিসহ অনেক জটিলতা রয়েছে। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে চাইলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এটা ব্যর্থ।
তিনি আরও বলেন, শিল্পনগরী স্থাপন সত্ত্বেও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এখনও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। বিদ্যুৎ, পানি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে শিল্পনগরী শুধু নামেই।
জাগো নিউজ: প্রশাসন ও সরকার এই শিল্পনগরীর কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে কি?
শাহারিন হক মালিক: দুর্ভাগ্যবশত তাদের কার্যকর সমর্থন নেই। স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তর শুধু কাগজপত্রে ব্যস্ত। উদ্যোক্তাদের সরাসরি সহায়তা বা তদারকি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
জাগো নিউজ: তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য চেম্বারের পরিকল্পনা কী?
শাহারিন হক মালিক: তরুণরা এখন ব্যবসায় আগ্রহী। আমরা তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও নেটওয়ার্কিং সুযোগ তৈরি করছি। নারী উদ্যোক্তাদেরও সমান গুরুত্ব দিচ্ছি। চুয়াডাঙ্গার অর্থনীতি টেকসই করতে হলে তরুণ প্রজন্মকে তো এগিয়ে আসতে হবে। তাই তরুণ উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করার ব্যাপারে আমরা খুব আগ্রহী।
জাগো নিউজ: সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় কোনো বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন কি না?
শাহারিন হক মালিক: না, আমরা অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। সীমান্ত জেলা হওয়ায় অতিরিক্ত সুবিধা থাকা উচিত ছিল, কিন্তু এখানে কোনো বিশেষ সুযোগ নেই।
জাগো নিউজ: দর্শনা রেলবন্দর ও সীমান্ত ব্যবসা বিষয়ে আপনার মত?
শাহারিন হক মালিক: দর্শনা রেলবন্দর দিয়ে আগে ভুট্টা, চাল, গম ও পাথরসহ প্রচুর পণ্য আসত। এখন নানা অস্থিতিশীলতার কারণে বলতে গেলে প্রায় সবই বন্ধ। যদি ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক হয়, ব্যবসার গতি ফিরে আসবে এবং বাজারে পণ্য সরবরাহ আরও সচল হবে।
জাগো নিউজ: দর্শনা কিংবা জীবননগরে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর চালু করার বিষয়ে কী উদ্যোগ আছে?
শাহারিন হক মালিক: পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর চালুর জন্য বহুদিন ধরে চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্সের নেতৃবৃন্দ কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কোনো ফলাফল নেই। তবে শুনেছি জীবননগর উপজেলার স্থলবন্দর আপাতত চালু না হলেও দর্শনা চেকপোস্ট সংলগ্ন একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর দ্রুত চালু হতে পারে। নির্বাচিত সরকার আসার পরই এটা হবে আমার বিশ্বাস। কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো কার্যকারিতা নেই, চুয়াডাঙ্গার ব্যবসায়ীদের জন্য কার্যকর উদ্যোগও আমার চোখে পড়েনি।
জাগো নিউজ: চুয়াডাঙ্গাকে ব্যবসাবান্ধব জেলা হিসেবে গড়ে তুলতে করণীয় কী হতে পারে?
শাহারিন হক মালিক: প্রথমত অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। রাস্তা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ এবং ব্যবসাবান্ধব নীতি থাকা জরুরি। তৃতীয়ত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পপার্ক তৈরি করতে হবে। এগুলো হলে চুয়াডাঙ্গা শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হবে।
জাগো নিউজ: স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা কেমন?
শাহারিন হক মালিক: স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকারিতা সীমিত। চুয়াডাঙ্গা চেম্বার সব ধরনের উদ্যোক্তার পাশে দাঁড়াচ্ছে। তাই স্থানীয় প্রশাসনকে আরও ব্যবসায়ীবান্ধব হতে হবে এবং চেম্বারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও কার্যকর করতে হবে বলে আমি মনে করি। চুয়াডাঙ্গাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগেরও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের স্থিতিশীলতা ও কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
জাগো নিউজ: সময় দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহারিন হক মালিক: আপনাকেও ধন্যবাদ।
এফএ/জেআইএম