ঢাকা ও ঢাকার বাইরের জন্য এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানি হওয়া পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তবে সরকার নির্ধারিত দামে প্রায় ৮৯ শতাংশ বা ৮৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ মানুষ কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। মাত্র ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ মানুষ সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে পেরেছেন। জাগো নিউজের নিজস্ব এক জরিপে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ২৬ মে কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০-৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা। ঢাকার বাইরের গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা।
এছাড়া ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৫০ টাকা। এছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা ও বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
জাগো নিউজের প্রতিবেদকরা ঈদের দিন ও ঈদের পরের দিন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির দৃশ্য সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনে দেখা যায়, ঢাকায় গরুর চামড়া আকার ভেদে ২০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কোথাও কোথাও ছাগলের চামড়া বিক্রিয় হয়নি। বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই রাস্তায় ছাগলের চামড়া ফেলে গেছেন।
আরও পড়ুন
- গত বছরগুলোর তুলনায় এবার চামড়ার দাম বেশি: বাণিজ্য উপদেষ্টা
চট্টগ্রামে বিক্রি করতে না পেরে ডাস্টবিনে চামড়া
তবে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়া। নির্ধারিত দাম কার্যকরে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ দল। বিগত বহু বছর ধরে যে দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে, এবারের দাম তার থেকে বেশি।
ঢাকা শহরের বেশিরভাগ চামড়া আসে লালবাগের পোস্তায়। ঈদের দিন শনিবার (৭ জুন) বিকেল হতেই রাজধানী ও আশপাশের এলাকা থেকে চামড়া আসতে শুরু করে পোস্তায়। ছোট ট্রাক, ভ্যান গাড়ি ও বিভিন্ন যানবাহনে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের সঙ্গে মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা চামড়া নিয়ে যান সেখানে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শনিবার ও রোববার আড়তদাররা গরুর চামড়া কিনেন ২০০ থেকে শুরু করে ৯০০ টাকার মধ্যে। ছোট গরুর চামড়া বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। মাঝারি ও বড় আকারের গরুর চামড়া বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায়। তবে আড়তদাররা দাবি করেন, শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে প্রতিটি চামড়ায় সরকার নির্ধারিত ১ হাজার ৩০০ টাকার মতো খরচ হয় তাদের।
এ বিষয়ে আরাফাত লেদারের কর্ণধার মো. জিবলু জাগো নিউজকে বলেন, আমরা সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা দরে চামড়া কিনছি। সরকার তো এর চেয়ে বেশি দাম নির্ধারণ করেছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চামড়া গোডাউনে ঢোকানো, লবণ লাগানো থেকে সব কাজে খরচ আছে কম করে ৪০০ টাকা। শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় কাঁচা চামড়ার দাম কিছুটা কম ধরছি আমরা। এরপরও সব মিলিয়ে সরকার নির্ধারিত ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকার মতোই খরচ হয় আমাদের।
হাজী ট্রেডিং করপোরেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, চামড়ার আকার অনুযায়ী দাম কম-বেশি হচ্ছে। এবার চামড়া বেশিরভাগই সাভার শিল্প নগরীতে চলে যাচ্ছে।
রাজধানী ও আশপাশের এলাকার কোরবানির পশুর চামড়ার একটা বড় অংশ কেনাবেচা হয় আমিনবাজারে। এখানে এবার বড় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকায়। তবে ছাগল ও ভেড়ার চামড়ার চাহিদা ছিলো না। আমিনবাজারের আড়তদাররা ছাগল ও ভেড়ার চামড়া কিনতে আগ্রহী না হওয়ায় কোনো কেনো মৌসুবি ব্যবসায়ী বাজার সংলগ্ন সড়ক ও ফুটপাতে এসব চামড়া ফেলে যান।
আমিনবাজারে ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে আসা মাকসুদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ছাগলের চামড়া কেউ নিচ্ছে না। এখন কী করবো বুঝছি না। ছাগলের চামড়ার দাম নেই। এতদূর থেকে ছাগলের চামড়া এনে বিপদে পড়েছি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহাদাত উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে যখন ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তর হয়, তখন ছাগলের চামড়া নিয়ে যারা কাজ করে তারা স্থানান্তর হতে পারেননি। এমন অসংখ্য ট্যানারি সাভারে যেতে পারেনি। এখন যে ট্যানারিগুলো আছে সেগুলোর ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা নেই। বাকি যেগুলো আছে ওই ট্যানারিগুলার অবস্থা খুবই খারাপ, ওরা দীর্ঘদিন লোকসানে আছে। অনেকগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার মতো বড় কোনো ট্যানারি নেই।
আকারে ছোট, প্রক্রিয়াজাতে খরচ বেশিসহ ছাগলের চামড়ার সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, মেইনটেন্যান্সে অনেক খরচ আছে। ছাগলের চামড়ায় বেশি কাট (চামড়া ছড়ানোর সময় কেটে যায়) হয়ে যায়। ছাগলের চামড়া আকারে ছোট, এ কারণে একটা দুইটা কাট থাকলে ন্যায্যমূল্য থাকে না। তখন প্রক্রিয়াজাত খরচও উঠে আসে না। এ জন্য ছাগলের চামড়ার প্রতি অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
এদিকে গতকাল রোববার (৮ জুন) কোরবানির পশুরু চামড়া বিক্রি পরিস্থিতি দেখতে পোস্তা যান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়া। নির্ধারিত দাম কার্যকরে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ দল।
তিনি বলেন, আমরা যে চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছিলাম সেটি ছিল লবণসহ দাম। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা যেটা বিক্রি হচ্ছে সেটি লবণ ছাড়া। বিগত বহু বছর ধরে যে দামে বিক্রি হতো এই দাম তার থেকে বেশি।
আরও পড়ুন
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম পাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, এটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা অসত্য। অসত্য এজন্য যে কিছু মৌসুমী ব্যবসায়ী যাদের চামড়া সংরক্ষণের ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতা নেই, তারা চামড়া নিয়ে আধা পঁচা করে ফেলছে। আধা পঁচা চামড়া ৭০০-৮০০ টাকা বিক্রি হলে তো এটা অনেক বেশি। আর যেটা ভালো চামড়া সেটি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে আমরা যে কাজটা শুরু করি তাহলো স্থানীয়ভাবে মজুত এবং লবণ দেওয়াকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে চামড়া সংরক্ষণ উপযোগী ও মজুত উপযোগী করা। যার ফলে বাজার ব্যবস্থাপনায় একটা স্থিতি এবং বাজারের চাহিদা ও সরবারহের মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি হয়।
তিনি আরও বলেন, মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন চামড়া ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে। জাতীয় পর্যায়ে আমরা একটি কন্ট্রোল রুম করেছি। সেখানে ২৪ ঘন্টা চামড়া ব্যবস্থাপনা মনিটরিং হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি চামড়ার উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যাচ্ছে, যেটা লবণ দেওয়া চামড়া। সরকার নির্ধারিত মূল্যেই সেটা বিক্রি হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া ও মেইনস্ট্রিমের কিছু মিডিয়াও ভুল তথ্য প্রচার করছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, সরকার সক্ষমতা তৈরীর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এ কাজে সহযোগিতা করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। লবণ লাগিয়ে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে উপযুক্ত দাম চান আমি আশা করি উপযুক্ত দামই পাবেন। আমি আশা করছি তার চেয়েও বেশি দাম পাবেন।
তিনি বলেন, সরকার চাহিদা তৈরির জন্য কাঁচা চামড়া এবং ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। প্রণোদনার ২২০ কোটি টাকা ছাড় করিয়েছে। সারাদেশের প্রত্যেক জেলায়, উপজেলায়, গ্রামে মসজিদে মসজিদে লবন পৌঁছে দিয়েছে। এখন এর সঙ্গে সকলের সংযুক্ত হতে হবে। এককভাবে সরকারকে দায়ি করে কিছু ভুল তথ্য ও অপতথ্য ছড়িয়ে চামড়ার বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করা ন্যাক্কারজনক কাজ হবে।
এমএএস/এমকেআর/জেআইএম