এক সময়ের উন্মুক্ত পল্টন ময়দান গিলে খেয়েছে বেশ কিছু ক্রীড়া স্থাপনা। ঐতিহাসিক এই ময়দানে নিঃশ্বাস নেওয়ার শেষ জায়গাটা গেছে রোলার স্কেটিংয়ের পেটে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৭ সালে অখ্যাত এ খেলাটির জন্য পল্টন ময়দানে তৈরি করা হয় বিশাল কমপ্লেক্স।
শেখ রাসেলের নামে প্রজেক্ট তৈরি করে ১১ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্রুতই নির্মাণ করা হয়েছিল বিশাল এই কমপ্লেক্স। অথচ আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে পদক আনা অনেক খেলার অনুশীলনের জায়গাই নেই।
ওই সময়ে বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। তিনি ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি। পল্টনের ফাঁকা জায়গায় দ্রুত কমপ্লেক্সে নির্মাণে তার প্রভাব ছিল বেশি। ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ছিল প্রকল্পের মেয়াদ। তার আগেই ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে কমপ্লেক্সে উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নবনির্মিত এই কমপ্লেক্স উদ্বোধনের পর সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল চতুর্থ রোলবল বিশ্বকাপ।
তৈরি করার পর ২০১৮ সালে রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স ইনডোরের ছাদে স্থাপন করা হয়েছিল ২০০ কিলোওয়ার্ট পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার প্যানেল। তখন থেকেই এই প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যোগ হয়ে আসছে জাতীয় গ্রিডে।
ঢাকা পাওয়ার ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) সাথে চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৮০০০ ইউনিটের বিপরীতে বর্তমান নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী ৯.৯৩ টাকা হিসেবে মাসিক প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা পেয়ে আসছে রোলার স্কেটিং ফেডারেশন।
সাত বছর ধরে ডিপিডিসি এই টাকা বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশন বরাবর পরিশোধ করে আসছে। দীর্ঘ এই সময়ে এই টাকা পরিশোধের ঘটনা কিভাবে ঘটছে, সে বিষয়ে কোনো হেলদোল ছিল না জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের।
রোলার স্কোটিং ফেডারেশনের কর্মককর্তারা রাজনৈতিকভাবে এতটা শক্তিশালী ছিলনে যে, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ টু-শব্দটি করার সাহস পর্যন্ত পেতো না। উল্টো পল্টনের বুকের ওপর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অতি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুতই নির্মাণ করে দিয়েছিল বিশাল এই কমপ্লেক্সটি।
দীর্ঘ ৭ বছর পর টনক নড়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। এখন তাদের মনে হয়েছে, সোলার প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাবদ টাকা তো তাদের হিসেবে জমা হওয়ার কথা। কারণ, এই স্থাপনা সরকারের। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দাবি করছে এই সোলার প্যানেল স্থাপনের খরচ তারাই দিয়েছে। তাই ডিপিডিসিকে উৎপাদিত বিদ্যুতের বিপরীতে টাকা জমা দিতে হবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুকূলে।
৯.৯৩ টাকা ইউনিটের হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ডিপিডিসি রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের অনুকুলে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জমা দিয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এই টাকার হিসাব চেয়ে চিঠি দিয়েছে রোলার স্কেটিং ফেডারেশনে। এছাড়া বুধবার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) শফিকুল ইসলাম এক চিঠিতে ডিপিডিসিকে এখন থেকে রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে স্থাপিত সোলার প্যানেল উৎপাদিত বিদ্যুতের বিপরীতে পরিশোধযোগ্য অর্থ তাদের প্রতিষ্ঠানের অনকূলে পরিশোধ করতে বলেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর গত ২৮মে বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের পূর্বের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন অ্যাডহক কমিটি গঠন করে। আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক আসিফুল হাসান, যার সময়েই পল্টনে কমপ্লেক্স হয়েছে এবং কমপ্লেক্সের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন হয়েছে।
তিনি জানান, নিজেরা অর্থ সংকুলান করে সোলার প্যানেল বসিয়েছিলেন। তার দাবি তখন নাকি কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছিল সোলার প্যানেল স্থাপনে। টাকা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনকূলে জমা না হয়ে কেন ফেডারেশনে জমা হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আসিফুল হাসান বলেছেন, ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তখন কিছু তো বলেনি। রোলার স্কেটিংয়ের সাথে ডিপিডিসির চুক্তি হয়েছিল লিখিতভাবে। ফেডারেশনে সেই চুক্তি তো আছে।’
বর্তমান সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিপিডিসির সাথে আগের কমিটির একটা চুক্তি ছিল। আমরা তো দায়িত্ব নিয়েছি কিছুদিন আগে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আমাদের কাছে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে, সোলার প্যানেল স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ডিপিডিসি কত টাকা ফেডারেশনকে দিয়েছে তার বিবরণ জানাতে। আমরা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্দেশনা পাওয়ার পর ডিপিডিসিকে চিঠি দিয়ে তারা কত টাকা ফেডারেশনকে এ পর্যন্ত দিয়েছে সেই বিবরণ চেয়েছি। তাদের কাছ থেকে হিসাব পেলেই আমরা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে সবকিছু উপস্থাপন করবো।’
গত মাসে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. জাহিদ হোসেনকে দিয়ে বিষয়টির অনুসন্ধান করিয়েছিল। ওই কর্মকর্তার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে ডিপিডিসি থেকে বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের অনুকলে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার মতো জমা হওয়ার বিষয়টি।
সেই ২০১৮ সাল থেকে এই টাকা জমা হয়ে আসছে রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের অনুকুলে। অথচ স্থাপনাটি সরকারি বিধায় প্রথম মাস থেকেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুকূলে টাকা জমা হওয়ার কথা। তাহলে এতদিন এ বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কেন তাগাদা দেয়নি?
জবাবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেছেন, ‘আমি জানার পর গত সপ্তাহে বিষয়টির অনুসন্ধান করেছিলাম। আগে তথ্যটি আমাকে কেউ জানায়নি। এখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্থাপনায় সোলার প্যানেল, সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের বিপরীতে পরিশোধযোগ্য অর্থ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অনুকূলে জমা হওয়াই বাঞ্ছনীয়।’
আরআই/আইএইচএস/