• টিকিটের প্রকৃত দাম কত জানে না যাত্রীরা
• সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী শ্রমিকরা
• সরকারের নির্দেশনা কানে তুলছে না ট্রাভেল এসেন্সিগুলো
আকাশপথে যাত্রীদের স্বার্থরক্ষায় প্লেনের টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রতারণা ঠেকাতে পারছে না সরকার। এ নিয়ে দফায় দফায় নির্দেশনা দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না ট্রাভেল এসেন্সিগুলো। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে নির্দেশনা দিলেও এখনো প্লেনের টিকিটের গায়ে বিক্রয়মূল্য উল্লেখ করছে না ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। অথচ ট্রাভেল এজেন্সি আইন অনুযায়ী, কেউ টিকিটের গায়ে মূল্য না লিখলে লাইসেন্স বাতিল ও কারাদণ্ড উভয় বিধানই রয়েছে। টিকিটের বিক্রয়মূল্য উল্লেখ না থাকায় যাত্রীরা জানতেও পারছেন না, টিকিটের প্রকৃত দাম কত, কিংবা তাদের কাছ থেকে কত টাকা বেশি হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, প্লেনের টিকিট কাটতে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তারা। বিশেষত এ প্রতারণার কবলে বেশি পড়ছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। কিন্তু তা বন্ধে সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকার একাধিকবার পরিপত্র জারি করলেও যথাযথভাবে তা প্রতিপালিত হচ্ছে না। ফলে প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশযাত্রায় আর্থিক জটিলতায় পড়তে হচ্ছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের দাবি, তারা আকাশপথে যাত্রীদের স্বার্থরক্ষায় প্লেনের টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রতারণা রোধে তৎপর রয়েছেন। টিকিটের গায়ে বিক্রয়মূল্য সংযোজনসহ যাত্রীর স্বার্থরক্ষায় একাধিকবার ট্রাভেল এজেন্সিগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাও বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা আশা করছেন, এবার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রতারকচক্রের মূলোৎপাটন করা যাবে।
সরকারের নির্দেশনায় প্লেনের টিকিটের গায়ে ট্রাভেল এজেন্সির নাম, লাইসেন্স নম্বর এবং টিকিটের বিক্রয়মূল্য স্পষ্টভাষায় লিখতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনা আমলে নিচ্ছে না ট্রাভেল এজেন্সিগুলো
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রতারণা বন্ধে গত ১১ ফেব্রুয়ারি একটি পরিপত্র জারি করে মন্ত্রণালয়। পরিপত্রে প্লেনের টিকিটের গায়ে ট্রাভেল এজেন্সির নাম, লাইসেন্স নম্বর এবং টিকিটের বিক্রয়মূল্য স্পষ্টভাষায় লিখতে বলা হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা আমলে নেয়নি ট্রাভেল এজেন্সিগুলো।
আরও পড়ুন
- সরকারের হস্তক্ষেপে প্লেনের টিকিটের মূল্য কমেছে ৭৫ শতাংশ
- বিমান টিকিটের অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি রোধে ১০ নির্দেশনা
- উড়োজাহাজের টিকিটের চড়া দাম, মালয়েশিয়া প্রবাসীদের ক্ষোভ
পরে গত ২১ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মির্জা মুরাদ হাসান বেগের সই করা আরেকটি পরিপত্র জারির মাধ্যমে এসব নির্দেশনা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। ওই পরিপত্রে বলা হয়, আগের জারি করা পরিপত্রে প্লেনের টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে যে নির্দেশনাগুলো দেওয়া হয়েছিল তা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে না। টিকিটের গায়ে টিকিটের বিক্রয়মূল্য উল্লেখ করার নির্দেশনা থাকলেও তা অনুসরণ না করার নজির দেখা যাচ্ছে।
এখন থেকে আকাশপথে যাত্রী সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণার্থে সব ট্রাভেল এজেন্সিকে প্লেনের টিকিটের গায়ে ট্রাভেল এজেন্সির নাম, লাইসেন্স নম্বর এবং টিকিটের বিক্রয়মূল্য স্পষ্টভাষায় লিখতে হবে—বলা হয় সবশেষ নতুন পরিপত্রে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, টিকিটের বিক্রয়মূল্য ও ট্রাভেল এজেন্সির নাম যথাযথ রয়েছে কি না তা যাত্রীকে বুঝে নিতে হবে। কোনোভাবে অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে টিকিট কেনা যাবে না। কোনো ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বা সিন্ডিকেটের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে ওই এজেন্সির নিবন্ধন বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এজেন্সি ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। এর মধ্যে ভিসা বা টিকিট বাবদ এজেন্সির সঙ্গে আলাদা কোনো কথা হয়নি। এজেন্সি থেকেও এসব বিষয়ে আলাদা করে আমাকে কিছু বলেনি।- সৌদিগামী শ্রমিক আকরাম হোসেন
এ নির্দেশনার তিনদিন পর গত রোববার (২৪ আগস্ট) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের ভ্রমণ প্রস্তুতি পরিদর্শন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি তখন যাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং তাদের অভিযোগ মনোযোগ দিয়ে শোনেন। পরে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
টিকিটের গায়ে মূল্য লেখে না এজেন্সিগুলো
ফেনীর আকরাম হোসেন। পেশায় দিনমজুর। মাস দুই আগে একটি এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে কর্মভিসায় আবেদন করেন তিনি। মাসখানেকের মধ্যে ভিসাও পেয়ে যান। পরে উড়োজাহাজের টিকিট কেটে সোমবার (২৫ আগস্ট) সকালে সৌদি আরব যাত্রা করেন। কিন্তু কত টাকা দিয়ে টিকিট কিনেছেন তা তার জানা নেই। এমনকি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে টিকিট কিনেছেন, সেটিও বলতে পারেননি।
পরে আকরাম হোসেনের টিকিট হাতে নিয়ে দেখা গেল, তিনি ভারতের ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের টিকিট কেটেছেন। কিন্তু এ টিকিটের গায়ে কোথায়ও মূল্য, এজেন্সি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ নেই। টিকিটে শুধু ফ্লাইট নম্বর, উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণ ও ট্রানজিটের সময় উল্লেখ থাকতে দেখা যায়।
মাসখানেক আগে মোবাইল ফোনে কল করে তালুকদার ট্রাভেল নামের ওই এজেন্সিকে টিকিটের কথা জানাই। তারা কাতার এয়ারওয়েজের টিকিট মূল্য রেখেছেন ৬৮ হাজার। সে অনুযায়ী নির্ধারিত টাকা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি।- কাতার প্রবাসী আসাদ হোসেন
শাহজালাল বিমানবন্দরের ডিপারচার-৪ নম্বর ফটকের সামনে আলাপকালে আকরাম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকার ফকিরাপুলের একটি এজেন্সির মাধ্যমে সৌদির কর্মভিসা ও টিকিটের কাজ করেছি। এর বিনিময়ে তারা ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। এর মধ্যে ভিসা বা টিকিট বাবদ এজেন্সির সঙ্গে আলাদা কোনো কথা হয়নি। এজেন্সি থেকেও এসব বিষয়ে আলাদা করে আমাকে কিছু বলেনি।’
‘সৌদিতে কর্মভিসায় যেতে এবং টিকিট কাটতে আসলেই কত টাকা খরচ হয়, তা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে’- আক্ষেপ করে বলেন এই বিদেশগামী যাত্রী।
মাসখানেক আগে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কাতারে যেতে রাজধানীর মতিঝিলের একটি এজেন্সি থেকে উড়োজাহাজের টিকিট কাটেন টাঙ্গাইলের আসাদ হোসেন। সোমবার (২৫ আগস্ট) সকালে এ টিকিট নিয়ে তিনিও শাহজালাল বিমানবন্দরে ঢোকেন। কিন্তু তার টিকিটেও কোন এজেন্সি থেকে টিকিট কেটেছেন, দাম কত সেসব কোনো তথ্য দেখা যায়নি।
জানতে চাইলে আসাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আট বছর ধরে কাতারে থাকি। প্রথমবার কাতার যাওয়ার সময় যে এজেন্সি থেকে ভিসা করিয়েছিলাম, পরে প্রতিবারই সেখান থেকে আসা-যাওয়ার টিকিট কেটেছি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।’
‘মাসখানেক আগে মোবাইল ফোনে কল করে তালুকদার ট্রাভেল নামের ওই এজেন্সিকে টিকিটের কথা জানাই। তারা কাতার এয়ারওয়েজের টিকিট মূল্য রেখেছেন ৬৮ হাজার। সে অনুযায়ী নির্ধারিত টাকা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি। পরিচিত ও বিশ্বস্ত এজেন্সি না থাকায় অন্য কারও থেকে টিকিট নেওয়া হয় না। তবে টিকিটের গায়ে প্রতিটি টিকিটের মূল্য ও এজেন্সির নাম উল্লেখ থাকলে যাত্রীদের জন্য ভালো হবে’- বলেন এ কাতার প্রবাসী।
আমি আটাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সবার সঙ্গে বসতে চেয়েছি। চিঠিও দিয়েছি। ক্রমান্বয়ে বসবো। বিদ্যমান সমস্যাগুলো কোথায়, তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজবো। পাশাপাশি একটি নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরে কাজ করবো।- আটাব প্রশাসক মোতাকাব্বীর আহমেদ
দেশে ট্রাভেল এজেন্টদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। সম্প্রতি সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে আটাবের কার্যনির্বাহী কমিটি বাতিল করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরে গত ১২ আগস্ট উপসচিব মোতাকাব্বীর আহমেদকে আটাবে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।
আরও পড়ুন
- শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল চালু নিয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা
- শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল প্রথমবার ব্যবহার করলো বিমান
- কম ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে লাভে বিমান, নাখোশ বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে আটাব প্রশাসক মোতাকাব্বীর আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আটাবে পাঁচ হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে আবার কয়েকটি প্যানেল বা গ্রুপ আছে। আমি আটাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সব প্যানেলের সঙ্গে বসতে চেয়েছি। তাদের চিঠিও দিয়েছি। তাদের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বসবো। বিদ্যমান সমস্যাগুলো কোথায়, তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজবো। পাশাপাশি একটি নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরে কাজ করবো।’
বিমান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্লেনের ভাড়ার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকার স্বল্পমেয়াদি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে। পরবর্তীসময়ে আইন বিধিমালা সংশোধনসহ মনিটরিং এবং সুশাসন নিশ্চিতে সামগ্রিক ব্যবস্থা নিয়েছে। এছাড়া গৃহীত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয় চারটি নির্দেশনা জারি, টাস্কফোর্স গঠন, লাইসেন্সবিহীন এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা প্রদান, নন-রিফান্ডেবল টিকিটের ট্যাক্স ফেরত প্রদান, আইন ও বিধিমালা সংশোধন এবং ট্রাভেল এজেন্সি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এসব বিষয়ে সোমবার (২৫ আগস্ট) সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিমান উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ী উদ্দেশ্যমূলকভাবে টিকিট সংকট সৃষ্টি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করছিল। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
‘আমাকে একটু সময় দেন। এটুকু নিশ্চিত থাকেন, কেউ এই ছাই দেওয়া হাত ফসকে বের হতে পারবে না। এই নৈরাজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত তারা কখনোই কোনোভাবে রেহাই পাবে না’- বলেন উপদেষ্টা।
এমএমএ/এমকেআর/এমএস